:: এ এম এম বাহাউদ্দীন ::
স্বল্প পরিসর জীবনে বহু দেশ ঘুরেছি। চলার পথে দেশ-বিদেশে অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে। কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকেছে আবার কর্মব্যস্ততার কারণে অনেক বন্ধুর খোঁজ-খবর নেয়া হয় না। দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে জানা-শোনা ও দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে; বন্ধুত্ব হয়েছে। কিন্তু আরাফাত রহমান কোকো একেবারেই ব্যতিক্রম। সে এক অন্যরকম, অতি সাধারণ মানুষ। বিনয়ী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অথচ নিভৃতচারী।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে কোকো এবং বিরোধী দলের নেতার পুত্র কোকোর ব্যক্তিজীবন ও আচরণে কখনো পরিবর্তন দেখিনি। অহমিকা এবং দাম্ভিকতা তার চরিত্রেই ছিল না। কোকোর অসময়ে চলে যাওয়ায় খুবই ব্যথিত হয়েছি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের। ক্যান্টনমেন্টের বাসায় অনেকবার গিয়েছি। ইনকিলাবের সম্পাদক হিসেবে হোক, রাজনৈতিক কারণে হোক বা দেশের একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবেই হোক বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। জিয়াউর রহমানের পুত্র হয়েও রাজনীতি থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৯৭ সালে।
বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় তার সঙ্গে আলাপ হয়। অতঃপর ঘনিষ্ঠতা। বিএনপি যখন বিরোধী দলে ছিল সেই ’৯৭ সালে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। সজ্জন এবং নিভৃতচারী কোকো সব সময় বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতো। কখনো আমাকে বড় ভাই, কখনো বাহাউদ্দীন ভাই বলে সম্বোধন করতো। আমার উত্তরার ভাড়া বাসায় খেলতে আসতো কোকো। শীতকালে প্রতি সন্ধ্যায় কোকো ও আমি ব্যাডমিন্টন খেলতাম। খেলার সময় প্রায়ই কোকো আমার সঙ্গে জুটি বাঁধতো। নম্র অথচ একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে যা বোঝায় কোকো ছিল তা-ই। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়ায় আমাকে আটপৌরে খবরের সঙ্গে থাকতে হয়। রাজনীতি নিয়েও ভাবতে হয়। খবরের পেছনের খবর খুঁজতে হয়। সে জন্য আড্ডা বা প্রয়োজনে যেখানে বসি সেখানে বিভিন্ন আলাপচারিতায় রাজনীতির প্রসঙ্গ আসে। আলাপচারিতায় খবর লেনদেন করি। কিন্তু জিয়ার পুত্র কোকো রাজনৈতিক পরিবারের মানুষ হয়েও রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে কখনোই আগ্রহ দেখাতো না।
কোকোর মৃত্যুর সংবাদ শুনে খুবই কষ্ট পেয়েছি। মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছি, আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত দান করেন। জন্ম, মৃত্যু আল্লাহর হাতে। জন্ম নিলে মৃত্যু অনিবার্য। কিছু কিছু মৃত্যু মনে দাগ কাটে। এতো অল্প বয়সে কোকো আমাদের ছেড়ে চলে গেল ভাবতেই ভারাক্রান্ত হই। আমি সংবাদপত্রের মানুষ। লেখাপড়া শেষ করতে না করতেই অল্প বয়সেই বাবার নির্দেশে পত্রিকার সম্পাদক হয়ে কর্মজীবন শুরু করেছি। সাংবাদিকতা ছাড়া অন্যদিকে মন দিতে পারিনি, চিন্তাও করিনি।
২০০২-৩ সালের কথা। বিএনপি ক্ষমতায়। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। একদিন কোকো দাওয়াত করলো। গেলাম তার গুলশানের ব্যক্তিগত অফিসে। একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কোকো আমাকে প্রস্তাব দিয়ে বললো, বড় ভাই আসেন দু’ভাই মিলে ব্যবসা করি। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমিতো ব্যবসার মাথামু্ন্ডু কিছুই জানি না। ব্যবসা সম্পর্কে তেমন ধারণাও নেই। বললাম, আমার সঙ্গে ব্যবসা করতে চাও, তুমি কি ম্যাডামকে বলেছ? ম্যাডাম (বেগম খালেদা জিয়া) কী জানেন? প্রধানমন্ত্রীর পুত্র কোকো বিনয়ের সঙ্গে বললো, আম্মু বলেছেন, আপনি ভালো মানুষ। এ জন্যই আপনাকে নিয়ে ব্যবসা করতে চাচ্ছি। ভাই, আপনি কয়েকদিন ভেবে-চিন্তে জানান। আমি ব্যবসা-বাণিজ্য বুঝি না। কয়েকদিন পর ইনকিলাবের বিশেষ সংবাদদাতা রেজাউর রহমান সোহাগকে নিয়ে গেলাম সেই অফিসে। আমি যে ব্যবসা বুঝি না তাকে জানাই। কিন্তু তার ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন নেই। অত্যন্ত সহজ-সরল কোকোকে মা (বেগম খালেদা জিয়া) বলেছেন, তাই আমাকে ব্যবসা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সাধাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত কোকোকে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে দেখেছি। আবার বিরোধী দলের নেতার ছেলে হিসেবেও দেখেছি। আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই। শেষ সময় পর্যন্ত যতটুকু যোগাযোগ ছিল আচার-আচরণে, শ্রদ্ধা-ভক্তিতে কোকোর কোনো পরিবর্তন দেখিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তার পরিবর্তন চোখে পড়েনি। সব সময় বিনয়ী ভাবে কথা বলতো। কোনো দিন সৌজন্যবশত প্রধানমন্ত্রীর পুত্র কোকোকে ১০-২০ টাকার ফুল পর্যন্ত উপহার দেইনি। অথচ যখনই দেখা হয়েছে বড় ভাই হিসেবে সম্মান করেছে। কোকোর ইন্তেকালের খবর শোনার পর সেসব কথা মনে পড়ছে।
লেখকঃ সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব
Awesome post! Keep up the great work! 🙂