:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বাংলাদেশে গত ১৪ বছরের মধ্যে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে গত অর্থবছরে। অতীতের সব রেকর্ডকে ভঙ্গ করে গত অর্থবছরেই রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
গত ১৪ বছরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৭ গুণের বেশি। বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি অব্যাহতভাবে ও রেকর্ড পরিমাণে বাড়তে থাকায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। বর্তমান ডলার সংকটের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের বিশাল ঘাটতি। এ ঘাটতি আরও বাড়তে থাকলে ঝুঁকিও বাড়বে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) থেকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। তারা বাণিজ্য ঘাটতিতে লাগাম টানার পরামর্শও দিয়েছেন।
বৈশ্বিক মন্দা ও দেশীয় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্বিক অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ৭৮৬ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ১ হাজার ৫৮৪ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ঘাটতি বেড়েছে ৫৯২ কোটি ডলার। অর্থাৎ ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ছিল ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘাটতি বেড়েছে ২০২ কোটি ডলার। অর্থাৎ ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১৪ বছরে দেশে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৭ গুণের বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল ৪৭১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঘাটতি বেড়েছে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ডলার। ওই সময়ে মাত্র ৪ অর্থবছর আগের অর্থবছরের তুলনায় ঘাটতি কমেছে। বাকি ১০ বছরই ঘাটতি বেড়েছে। এর মধ্যে গত ৬ অর্থবছরেই ঘাটতি ৯৪৭ কোটি ডলার থেকে বেড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলারে উঠেছে।
২০১৬-১৭ থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬০ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১২৪ শতাংশ। ওই সময়ে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এভাবে প্রতিবছর মাত্রাতিরিক্তভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বাজারে ডলার সংকট প্রকট হয়েছে। আগে এ সংকট রেমিট্যান্স থেকে মেটানো হতো। কিন্তু গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ও আমদানি বেশি মাত্রায় বাড়ায় রেমিট্যান্স দিয়ে আর ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না। ফলে ডলার সংকট প্রকট হয়ে এর দাম বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে টাকার মান। এতে একদিকে পণ্যমূল্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির হারে বাড়তি চাপ পড়ছে। কমে যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে এলোমেলো করে দিয়েছে।
নেপাল, থাইল্যান্ডে ঘাটতি বেশি হলেও ওইসব দেশ রেমিট্যান্স ও পর্যটন খাত দিয়ে তা মিটিয়ে ফেলে। কিন্তু বাংলাদেশ আগে রেমিট্যান্স দিয়ে ঘাটতি মেটাতে পেরেছে। ফলে ডলারের বড় সংকট হয়নি। কিন্তু এখন পারছে না। আর পর্যটন বা অন্য খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে খুবই কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, যে পরিমাণে আমদানি বাড়ছে, সে পরিমাণে রপ্তানি বাড়ছে না। রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এ ঘাটতি বাড়ার কারণে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাব নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। এতে বাজারে ডলারের জোগান কমে গেছে। অন্যদিকে আমদানি বাড়ায় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলারের জোগান দেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখাই হয় সংকটের সময়ে চাহিদা মেটানোর জন্য। বর্তমানে বাজারে ডলারের সংকট চলছে। এ কারণে রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান দিয়ে চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। দেশটির অর্থনীতির আকার বাড়ায় আমদানি বেড়েছে। কিন্তু রপ্তানিকে তারা বহুমুখীকরণ করতে পারেনি। শুধু পোশাক খাতের ওপর ভর করে রপ্তানি এগিয়ে যাচ্ছে। যা অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করেছে। দেশটির অর্থনীতি রপ্তানি নির্ভর হয়ে উঠেছে। বর্তমান বৈশ্বিক মন্দায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানির বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হয়েছে। এতে রপ্তানি কমে যেতে পারে। যা দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে চাপ বাড়াবে। বিশ্বব্যাংক আমদানি বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানি খাতকেও বহুমুখী করার কথা বলেছে।
এদিকে আইএমএফ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি প্রকট হয়েছে। এ কারণে ডলার সংকট। এ থেকে টাকার মান কমছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার।
দুটি সংস্থাই বাণিজ্য ঘাটতির এই ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা এ ঘাটতি কমাতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করে তৈরি পোশাক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। যা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৩৭৮ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘাটতি বেড়েছে ৯৪৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ।
করোনার পর হঠাৎ করে পণ্যের চাহিদা ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া আমদানি বেশি বাড়ার নেপথ্যে এর মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ৭৮৬ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ১ হাজার ৫৮৪ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ঘাটতি বেড়েছে ৫৯২ কোটি ডলার। অর্থাৎ ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ছিল ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঘাটতি বেড়েছে ২০২ কোটি ডলার। অর্থাৎ ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
প্রতিবেদন থেকে আরও দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৪৬ কোটি ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯৯২ কোটি ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৮০ কোটি ডলার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭০১ কোটি ডলার, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৯৩২ কোটি ডলার, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৭৭৫ কোটি ডলার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৫১৬ কোটি ডলার এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৪৭১ কোটি ডলার বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছিল।