শহীদুল জাহীদের একগুচ্ছ কবিতা

নারীর জয়গান

-শহীদুল জাহীদ

নারী হয়েছ ভালই করেছ, শ্রেষ্ঠ সে তো নারী,
মোরা পুরুষ সাদামাঠা ভাই, তোমাদের সাথে কী পারি?
জন্মদাত্রী মাতৃ তুমি উচ্চাসনে তুমি,
আমাদের শ্লেষ, আমাদেরই হেলা, তোমায় তো সবেই চুমি।
মাতৃদেবী, দুঃখ কেন? মনটা ফেল ঝাড়ি,
তোমার ঐ দুঃখ রবে না তো – পড়ে দেখ এই জারী।
ভগ্নী, ফুপু, স্ত্রী, মাতৃ – মাতৃ গরিয়স,
বল দেখি নারী! কে বা আছে তোমার চেয়ে সরস?
তুমিই হোলে চাবি রক্ষী, বাড়ির কর্তী মাতা,
আর নাই সে কাল, যবে নারী ঘুরাতো যবের যাঁতা।
বধূবেশী তুমি, রাঙ্গা শাড়ি চরণে শোভা পায়,
কত আদুরে হেলিয়া দুলিয়া শ্বশুর বাড়ি যায়।
স্বামীর সোহাগ পায় গো নারী, পাওতো যতন শত,
মরমী তুমি অমর তুমি, ভাস্কর অম্লান কত!

আজ অধিকারে নারী,
পুরুষের পাশে বসেছ তুমি, চালাও শকট গাড়ি।
সেবা দাও মাতা, ভগ্নী ও ফুপু- তোমার সেবায় ধরা,
হয়েছে পূত, ফুটেছে ফুল, একদিন যে ছিল জড়া।
তুমি হলে সেই বিবি রহিমা, রাঁধা, দুর্গা- দেবী,
করপুটে মম: শূন্য আজি, তবুও তোমায় সেবি।
চাই সে দোয়া, দিও না খোয়া- পরশু কালে ওহে,
জন্মাবে নব্য জাতের জাতি- ভরবে ধরা স্নেহে।
সেদিন কিন্ত দুখী নারী- বলবে নাকো আর,
মন মাঝে যত দুঃখ আছে – কর তারে ভাই সাবাড়।
পরবাসী হই, যাতনা সই- মরি যুদ্ধে পুরুষ মোরা,
পেলে নাকো সুধা, অন্য কোথাও- গাঁথিয়াছ তাই জোড়া।
পুরুষের খোয়া, তোমাদের দোয়া, এই মিলি তো সাধ,
জীবনের বৃথা, কাঁদিতে মাতা, দেখতাম ধরণী কাঁদ কাঁদ।

**********

ভাঙ্গা ল্যাম্পপোস্টের নীচে প্রিয়তমা

-শহীদুল জাহীদ

আচ্ছা, ভাবতো, এমন এক পৃথিবী,

যেখানে নিভে গেছে সূর্যের আলো,

পবনের হারা গতিবেগ,

নদীরা শুকিয়ে মরা বালুচর,

পাহাড়ের চুড়ায় গর্জেনা কালো মেঘ।

ফসলের মাঠ যেন ধূ ধূ মরুভূমি,

বট ডালে বসে না পাখি, নেই কিচিরমিচির,

মৌমাছি ভুলে গেছে রানির খবরাখবর,

নেই কোথা ঠাকূমা’র গল্পের আসর।

থেমে গেছে তানপুরার সুর,

দক্ষ বাঁশরি ভোলে বাঁশির কারুকাজ,

কবির কলমের কালি সদ্য হোল শেষ,

ময়ূরী ঝিমায়, পায়না বৃষ্টির আবেশ।

দিনান্তে পথিকের অচল পা,

পাথারে নেই বৈঠার ছলাত ছলাত চুমু,

ভুলে আছে মাঝির গলে নীল দরিয়ার গান,

বিমুঢ় লাজে যেন ভাসে ফাঁকা আসমান।

ভুলে আছে বায়ুদেব প্রলয় উচ্ছ্বাস,

জ্বলেনা প্রদীপের শিখা সলতের প্রাণ,

গোধূলির সব মায়া চলে গেছে দূরে,

চেনা কবুতর ভাবে, এ কোন অচিনপুরে!

ভাবতো, এমন অচলা পৃথিবীর গভীর সান্ধ্যক্ষণে,

প্রিয়ার কাজল ভরা চোখে সাহারার দৃষ্টি লয়ে,

পল দণ্ড ক্ষণ মেপে অবাক প্রেমিক

হৃদয় সেঁকে যায় প্রেমের বহ্নি শিখায়,

ভাঙ্গা ল্যাম্পপোস্টের নীচে আজানুলম্বিত শুয়ে শুয়ে।

**********

প্রিয়ার কল্প বদন

-শহীদুল জাহীদ

পুষ্পিতার জেগে ওঠা সুরুজের ডাকে,

পবনের ইশারায় নাচে তরু শাখা,

বৃষ্টির ঘ্রাণে বাড়া চাতকের তৃষ্ণা,

খরা ভেবে বালুকার ঝিকিমিকি আঁকা।

সত্যি ভেবে স্বপ্নগুলি রাত্রি বিভোরে

পাগলামো বেড়ে যায় নক্ষত্রের সমান,

যেন দেখি নবকলি উড়ন্ত বাতাসে,

বৃন্তমূল শক্ত করি ওড়ে আসমান।

আন্দোলিত বুকে ডাকি সে আমি তোমায়,

পিঞ্জর উদাস করি বাসি ভাল তারে,

নয়নে নয়নে ফেলে মাপি তার হৃদে,

যাতনা দহনে হাসি হৃদয় মাঝারে।

তব হাসি তব গাই শক্তি যেন তুমি,

প্রিয়ার কল্প বদন নেত্র মুদে চুমি।

**********

হৃদয়ে প্রেয়সীর নগ্ন বিরাজ

-শহীদুল জাহীদ

তোমার পরশে ধন্য কর হে মহাকবি,

তোমার পরশে জাগরিত এ ধারা ছবি।

যেন তরুলতা খুশির দোলায় আন্দোলিত ছায়া,

তোমাতে দেখি আমার আরশি যেন জন্মান্তরের মায়া।

তোমার আবক্ষ দিল, খোলা আসমানে,

ভাসি আমি ইচ্ছে ঘুড়ি সমানে সমানে।

মেঘমেদুরে ঘুরে আসি পবনের বেগে,

উর্বশী জঠরে জীবনের বীজ জীয়ন্ত আবেগে।

পিয়ে যাই অমৃত সম তোমার দৃষ্টি ঘন,

মধু মাখা সরস প্রেম নির্গত ভাষণ।

প্রেমে মজি অবাধ্য আমি ছুঁয়ে যাই কাঞ্চন চূড়া,

তোমার চুম্বনে নাশি গরল পিয়াস স্বর্গ সুরা।

তোমার বাহুডোরে নগ্ন আলিঙ্গনে ভুলি কল্প বিলাস,

মহাসাগরে সুনামি যেন যৌবন উচ্ছ্বাস,

পাগলামি ভরা আষাঢ়ে বাদল, কদমের খোলস,

তোমাতে জাগি প্রেয়সী আমি চির অম্লান বিরস।

হে মহাকবি, তব তোমঃ হৃদয় মাঝে,

স্বপ্ন নহে এ প্রেয়সী সদা নগ্ন বিরাজে।

**********

জানি আমি জানি

-শহীদুল জাহীদ

কত ফুল ঝরে গেলো অগোচরে মালীর,

ধন্য তবু হলি নারে প্রেমার্ঘ দেবীর।

সহসা মনে মনে অশনির তীর,

জাগায় নব কিষান তুমি চষিয়া ফির।

অমাবস্যা চন্দ্র কভু হয়নিত চাঁদে,

ধরিয়া রাখিত শশী কুক্কুর ফাঁদে।

দেখে যাও বিষয়ীর বিজয়ী নেশা

শয্যা ভাঙ্গে তবু মাগে মোর তৃষা।

দেখা দাও ভিখারি হয়ে আমার বুকে

নব্য কথা বাজিকর  হারানোর  সুখে।

বাজায়  সহসা এক  ধনাঢ্য রবি,

জ্যোতি  যেন পূর্বাশায় ঊষা শীতল ছবি।

মম মানবী তুমি নেশায় স্বপন,

এ ধারায় ধন্য হত নামিলে ভুবন।

জাগো  দেবী  সূর্য সম তেজ দাও মাখি,

আমাদের সুখ তবু  দুঃখ রাজায় ডাকি।

ভিখারি সহসা দাড়ায়; মুর্ছিয়া গেল,

ডাকি  তবু হায় হায়-কি তোমরা পেল?

মানসী আমার! ধন্য বুকে  ধন্যি এলি

আমার মন্দিরে তাই ভিখারিরে পেলি।

সর্ব তীর  শুষ্ক এল এক তীরে পানি

দেখা দেয়, বলে আবার, জানি আমি জানি।

**********

প্রথম দেখায়

-শহীদুল জাহীদ

আমার এমন, ভাবে আলাপন

পাহাড়ের চূড়া দেশে যে নীল অতি ঘন

কিংবা শেষ বিকেলের বর্ণালী আকাশের

স্বর্ণালী আলোকচ্ছটা যেন; আরও কত কিছু

যেন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সুগভীর খাঁদ;

সবুজের সমারোহে ফসলের মাঠ,

যেন ভরা নদী উজানে বায় গুণটানা মাঝি,

তুলোকেশি মেঘ আর নীলাভের লুকোচুরি।

আমার এ মন, ভাবে আলাপন

তপ্ত দুপুর রাখালের সুর

গোধূলির মানচিত্রে পশুদের রাঙ্গানো ক্ষুর,

কৃষাণির তারা, কৃষকের বারিক হাট বেলা

ছোট্ট শিশুর আলতা পায়ে, ঘাঘরা আর নূপুর।

দুরন্ত পথিকের নিরন্তর বেলা

মুটে আর মজুরের বিকেল অলস অবহেলা

পাখিদের সুখের কিচির,

সুউচ্চ বৃক্ষের অহমিকায় দোলা;

আমি ভাবি সবই তোমায়।

প্রথম দেখায়,

আমার এ মন, ভাবে আলাপন

তোমার সুগভীর চোখ যা

আমার কাছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন।

দক্ষ ডুবুরি আমি, নেমে যাব সায়

চোখের দুবাহু পেরিয়ে সে এক নির্জন আভায়

যেন আমাজনের শেষ প্রান্তে,

হে কিশোরী মন, তুমি রচিয়াছ

আমার তরে স্বর্গ বাসর।

**********

স্বর্গ-আধার-পুরী

-শহীদুল জাহীদ

রাত্রি গভীর হয়,

প্রিয়ার চাহনির তেজ,

বাড়তে থাকে সাজ, সুরমার কারুকাজ আর

লম্বিত বেণী যার শেষ প্রান্তে লাল ফিতার বাহার।

চুলে দেয় সুগন্ধি তেল,

কপালে টিপের আয়োজন,

ভুরু গুলো ছেঁটে নেয় সুদক্ষ হাতে,

কপোলে ভূষা মিশে যেতে পাগলামিতে মাতে।

ছিপছিপে নাক তার,

বিধাতার দক্ষতার উৎকর্ষ বিচার,

ঠোঁটে যেন লালেরা করিছে খেলা,

পরিপাটি দন্তমূলে হাসিদের সীমাহীন মেলা।

কানে তার দুল,

ধরা গলে নেই কৃত্তিম হার,

কালো তিল জানান দেয় বুকের মদ্দিখান,

ছোট জামা বলে দেয় এ পৃথিবীর জমিন অসমান।

নাভি বেশ কালো,

তলপেটের রেখাগুলো যেন সহস্র নদীর ধারা,

কামকেশ উঁকি দেয় পেটিকোটের ফিতে বাঁধা স্থানে,

তারও একটু নিচে স্বর্গ-আধার-পুরী, কবি সব জানে।

উরু গুলি ধরিত্রী পিলার,

সদা নাচে খাঁজের ভাঁজে ভাঁজে,

পেঁচানো শাড়িতে লাজ ভাঙ্গা নববধূ মুখ,

হে পুরুষ! এথা হেন তুমি কোথা খোঁজ এ জনমের সুখ?

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *