:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ২০২১ সালে বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করেছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। শীর্ষ তিনে থাকা অপর দুটি সংস্থা হলো পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। এই তিন খাতে ঘুসও নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এরপর রয়েছে- বিচারিকসেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য (সরকারি ও এমপিওভুক্ত)।
বুধবার (৩১ আগস্ট) রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক জরিপের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের সেবার ওপর এই জরিপ করা হয়।
এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সেবা খাতে দুর্নীতিতে কিছুক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সার্বিক তথ্য উদ্বেগজনক। বিচারিক খাতের দুর্নীতিও উদ্বেগজনক। যারা অনিময় করছেন, তারা ঘুসকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন। যারা দিচ্ছেন তারা জীবনযাপনের অংশ করে নিয়েছেন।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বা পরিবার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ভুমি সেবায় ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ঘুস গ্রহণের জরিপে উঠে এসেছে, ৪০ দশমিক ১ ভাগ সেবাগ্রহীতাকে ঘুস দিতে হয়েছে। এরমধ্যে পাসপোর্টে ৫৫ দশমিক ৮ ভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৫৫ দশমিক ৭ ভাগ, বিআরটিএ ৫০ দশমিক ২ ভাগ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৩৩ দশমিক ৫ ভাগ, ভ‚মি সেবা ৩১ দশমিক ৫ ভাগ।
টিআইবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুসের শিকার খানার হার হ্রাস পেয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ, সেটা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ।
টিআইবির খানা জরিপে আইনশৃঙ্খলা বাহনী দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আখতার হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে দুর্নীতি কমিয়ে আনার ব্যপারে নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে অন্যান্য পদে বছাই করা অফিসার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন থানায় জিডি করতে বা অন্যান্য সেবায় হয়রানি কমেছে। কারণ থানাগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয় থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। তবে ২-১টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। সেটার ওপর ভিত্তি করে যদি ঢালাওভাবে নেতিবাচক কথা বলা হয় সেটা উচিত হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে। অপরাধ করলে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই শাস্তির মুখোমুখি করা হচ্ছে।
পরিবার প্রতি ঘুস ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা
বিভিন্ন সেবা পেতে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুস দিতে হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে দেশে ঘুস দেওয়া টাকার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি। মোট ১৭টি সেবা খাতে এই ঘুষের টাকা দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এই হিসাবে দেশে মাথাপিছু ঘুস দেওয়ার পরিমাণ ৬৭১ টাকা। এর আগে ২০১৭ সালে টিআইবির জরিপে প্রতিটি খানাকে গড়ে ঘুস দিতে হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩০ টাকা; ২০২১ সালে তার পরিমাণ বেড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই সময়ে দেশে গ্রামাঞ্চলে সেবা খাতে ঘুষের শিকার বেশি হয়েছে। নিæ আয়ের লোকজনের ওপর দুর্নীতির বোঝা অপেক্ষাকৃত বেশি। পাসপোর্ট, বিআরটিএ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মতো কিছু সেবা খাতে ডিজিটালাইজেশন পুরোপুরি না হওয়ায় দুর্নীতির পরিমাণ বেড়েছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সার্বিকভাবে সেবা খাতে দুর্নীতি বেড়েছে। সেবা খাতের দুর্নীতির এই চিত্র উদ্বেগজনক। শুধু সেবা খাতের ‘পেটি করাপশনের (ছোট দুর্নীতি)’ মাত্রাই এত ব্যাপক। বড় প্রকল্প, বড় কেনাকাটায় দুর্নীতির মাত্রা আরও বেশি বলেই ধারণা করা যায়। দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা সরকারের কাছে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় না। এই প্রতিবেদন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিবাচকভাবে নিয়ে দুর্নীতি কমাতে উদ্যোগ নেবে।
সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত
টিআইবি নিজস্ব জরিপ পর্যালোচনা করে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসাবে চিহ্নিত করেছে-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং ভ‚মি সেবা।
দুর্নীতির ধরন
সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণকে ৫৫ দশমিক ৫ ভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা, ৪০ দশমিক ১ ভাগ ঘুস, ২৩ দশমিক ৪ ভাগ অসদাচরণ ও হয়রানি, ৫ দশমিক ৭ ভাগ স্বজনপ্রীতি, ৫ দশমিক ৫ ভাগ প্রতারণা, ৩ দশমিক ৫ ভাগ প্রতারণা এবং ৩ দশমিক ৪ ভাগ আÍসাতের শিকার হয়েছেন।
ঘুস দেওয়ার কারণ
সেবাগ্রহীতারা ঘুস দিয়েছেন-ঘুস না দিলে সেবা মেলে না; এজন্য ৭২ দশমিক ১ ভাগ, হয়রানি এড়াতে ৫৯ দশমিক ২ ভাগ, যথাসময়ে সেবা পেতে ৪৪ দশমিক ৬ ভাগ, নির্ধারিত ফি জানা না থাকায় ৩৯ দশমিক ৯ ভাগ, নির্ধারিত সময়ের পূর্বে সেবা পেতে ৭ দশমিক ৮ ভাগ এবং অবৈধ সুবিধা পেতে ৬ দশমিক ৭ ভাগ।
বয়সভেদে দুর্নীতির শিকারের চিত্র
৫৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সি মানুষ বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এরপরের তালিকায় রয়েছেন, ৪৬ থেকে ৫৫ বছর বয়সি (৫৫.৯ ভাগ), ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সি (৫৪.৮ ভাগ), ৬৫ বছর বয়সি (৫০ ভাগ), ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি (৪৭.৫ ভাগ), ১৮ বছর বয়সি সেবাগ্রহীতারা (৩০.৩ ভাগ)।
অভিযোগের চিত্র
দুর্নীতির শিকার হয়ে মাত্র ১৮ দশমিক ৯৪ ভাগ মানুষ অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ গ্রহণ করা হয়নি ১ দশমিক ৯২ ভাগ মানুষের। তবে ৭৯ দশমিক ১৪ ভাগ মানুষ অভিযোগই দায়ের করেননি। ৯৭ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। দুদকের কাছে শূন্য দশমিক ২ ভাগ এবং অন্যান্য জায়গায় ৩ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ। এসব অভিযোগের ৭২ দশমিক ৩ ভাগের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আর ১৪ দশমিক ৮ ভাগ মানুষের সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। তদন্ত শুরু ৬ দশমিক ৫ ভাগের, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ৪ দশমিক ১ ভাগের, ঘুসের টাকা ফেরত ১ দশমিক ৬ ভাগ, অভিযোগ ফিরিয়ে নেওয়ার চাপ দেওয়া হয়েছে ১ দশমিক ৬ ভাগের এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে শূন্য দশমিক ৭ ভাগ।
দুর্নীতি ও ঘুস বেড়েছে
টিআইবির জরিপ বলছে, ২০১২ সালে দুর্নীতির শিকার পরিবারের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৩ ভাগ, ২০১৫ সালে ৬৭ দশমিক ৮ ভাগ, ২০১৭ সালে ৬৬ দশমিক ৫ ভাগ এবং ২০২১ সালে ৭০ দশমিক ৮ ভাগ। আর ২০১২ সালে গড় ঘুসের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৪২ টাকা, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৫৩৮ টাকা, ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৯৩০ টাকা এবং ২০২১ সালে ৬ হাজার ৬৪০ টাকা।
জরিপের আওতা ও ধরন
জরিপে সংশ্লিষ্ট খানা বা পরিবারে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা হয়েছে। যারা সেবা গ্রহণ করেননি; জরিপে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। এই জরিপে সেবা খাতে ব্যক্তিস্বার্থে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারকে দুর্নীতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। জনগণ সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে-ঘুস, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, আÍসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব বিস্তার এবং সময়ক্ষেপণ ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জরিপের আওতাভুক্ত খাত
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বিমা, কর ও শুল্ক, ব্যাংকিং, এনজিও (ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ), জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তা এবং অন্যান্যের মধ্যে-মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শপিং, ওয়াসা, নির্বাচন কমিশন, ডাক বিভাগ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সেবা বিষয়ে জরিপ করা হয়েছে।
জরিপ পদ্ধতি
টিআইবি সেবা খাতের জরিপ কার্যক্রম ৩টি পর্যায়ে সম্পন্ন করেছে। প্রথমত, দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি স্তরে বিভাজন করে। এরপর জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১ হাজার ৩২০টি গ্রাম বা মহল্লা নির্বাচন করে। এরমধ্যে গ্রামাঞ্চল ৮২০টি ও শহরাঞ্চল ৫০০টি। দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত গ্রাম বা মহল্লার ১০০ খানা বা পরিবারকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক গুচ্ছে ভাগ করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে ১০০টি খানা বা পরিবার না পেলে ৬০টি গ্রহণ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, তালিকাভুক্ত ১০০টি খানা বা পরিবার থেকে ১২টি নির্বাচন করা হয়। জরিপের আওতাভুক্ত মোট খানা বা পরিবারের সংখ্যা ১৫ হাজার ৮৪০টি। এরমধ্যে শহরাঞ্চলের খানা ৫ হাজার ৮০২টি এবং গ্রামাঞ্চলের খানা ৯ হাজার ৬৫২টি। এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ২০ জন মাঠ তত্ত্বাবধায়ক ও ৯৩ জন মাঠ তথ্য সংগ্রহকারী নিয়োগ করা হয়। তাদের ১৪ দিনের প্রশিক্ষণও প্রদান করা হয়।
১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি ‘সেবা খাতের দুর্নীতি, জাতীয় খানা জরিপ’ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ পর্যন্ত খানা জরিপ কাজ সম্পন্ন হয়েছে- ১৯৯৭, ২০০২, ২০০৫, ২০০৭, ২০১০, ২০১২, ২০১৫, ২০১৭ এবং ২০২১ সাল।
সেবাখাতে দুর্নীতির সার্বিক চিত্র
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের খানা জরিপে দেখা যায় সারাদেশে জরিপকৃত খানাগুলোর ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোনো না কোনো খাত থেকে সেবা নিয়েছে এবং সেবাগ্রহণকারী খানার ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে সেবাগ্রহণকারী খানাগুলোর দুর্নীতির শিকার হওয়ার মাত্রা ছিল সর্বাধিক (৭৪.৪%)। দুর্নীতির মাত্রায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পাসপোর্ট (৭০.৫%) ও বিআরটিএ (৬৮.৩%)। বিচারিকসেবা (৫৬.৮%), স্বাস্থ্য (৪৮.৭%), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (৪৬.৬%) এবং ভূমির (৪৬.৩%) মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে সেবাগ্রহীতা খানাগুলো দুর্নীতির শিকার হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে সেবাগ্রহণকারী খানার ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এ হার ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ। সেবাগ্রহণকারী খানার মধ্যে ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ ঘুস দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে।
এছাড়া সেবাগ্রহণকারী খানাগুলো অসদাচরণ (১১.৯%), থানা হাজতে/প্রিজন ভ্যানে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন/সামাজিক দূরত্ব না মানার শিকার (১০%), ভয়-ভীতির শিকার (৮%), মিথ্যা মামলায় জড়ানো (৫%), সাধারণ ডায়েরি বা এজাহার গ্রহণে অবহেলা বা সময়ক্ষেপণ (৪.১%), অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নেওয়া/সাড়া না দেওয়া (৩.৬%) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা থেকে সেবা নিতে গিয়ে যেসব খানা ঘুস দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে তাদেরকে গড়ে ৬ হাজার ৬৯৮ টাকা দিতে হয়েছে।
পাসপোর্ট
অনিয়ম ও দুর্নীতি
জরিপে পাসপোর্ট সেবাগ্রহণকারী খানার ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। পাসপোর্ট সেবাগ্রহণকারী খানার ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ ঘুসের শিকার হয়েছে এবং খানা প্রতি গড় ঘুসের পরিমাণ ১ হাজার ৫৫ টাকা। গ্রামাঞ্চলের খানাকে গড়ে ৫ হাজার ২২৯ টাকা ও শহরাঞ্চলের খানাকে গড়ে ৪ হাজার ৯১৫ টাকা ঘুস বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে।
এছাড়াও সেবাগ্রহণকারী খানাগুলো সময়ক্ষেপণ (২৪.৪%), দালালের সহযোগিতা নিতে বাধ্য করা/ দালাল নির্ভর সেবা (১৬%), হয়রানি (১০.৫%) এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলার (৫.৫%) শিকার হয়েছে।
বিএরটিএ
বিআরটিএ থেকে সেবাগ্রহণকারীদের ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ খানা কোনো না কোনো সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। অঞ্চলভেদে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শহরাঞ্চল (৬৬.৬%) অপেক্ষা গ্রামাঞ্চলের (৭৬.৮%) সেবাগ্রহীতা খানাগুলো বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছে। অপরদিকে বিআরটিএ হতে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে মোটরযান মালিক (৪৪.৬%) অপেক্ষা মোটরযান চালক সংশ্লিষ্ট সেবায় (৭২.৩% ) দুর্নীতির শিকার হওয়া খানার হার বেশি। সেবাগ্রহীতা খানাগুলোর মধ্যে ৫০ দশমিক ২ শতাংশ সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘুস দিয়েছে বা তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় করা হয়েছে।
এসব দুর্নীতি থেকে উত্তরণে টিআইবির ১০টি সুপারিশ
১. বিভিন্ন সেবাখাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনানুগভাবে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সক্রিয় ভূমিকা পালন করারও সুপারিশ জানিয়েছে সংস্থাটি।
২. সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হ্রাসে সব সেবা ডিজিটালাইজ করতে হবে। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করতে হবে এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. সেবাপ্রদানকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সেবাপ্রদানকারীদের আচরণগত বিষয়গুলো জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে।
৪. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
৫. সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।
৬. সংশ্লিষ্ট সেবাখাতে নাগরিক সনদে সেবামূল্য সম্পর্কিত তথ্য হালনাগাদ করতে হবে এবং তা দৃষ্টিগোচর স্থানে স্থাপন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কার্যকর করতে হবে, যেখানে সাধারণ সেবাগ্রহীতার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে।
৭. সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিরসন প্রক্রিয়া (জিআরএস) সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
৮. যেসব খাতে জনবল, অবকাঠামো ও লজিস্টিকসের কারণে সেবাদান ব্যাহত হয়, সেসব খাতে বিদ্যমান ঘাটতি দূর করতে হবে।
৯. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সামাজিক আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
১০. দুর্নীতি প্রতিরোধে সব পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।