:: নাগরিক বিনোদন ::
মায়ের মৃত্যুশোকে আত্মহত্যা করেছেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগের পরিচালক সাদি মহম্মদ। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।
এই সংগীতশিল্পীর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন তার ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ ও শিল্পীর পারিবারিক বন্ধু শামীম আরা নীপা। প্রাথমিকভাবে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা বলেন, ‘মা মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। মা হারানোর বেদনা সম্ভবত নিতে পারেননি। এভাবেই চলছিলো। বুধবার রোজা রাখলেন। ইফতারও করলেন। এরপরই তিনি নীরবে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ধারণা করছি।’
অন্যদিকে সাদি মহম্মদের ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আমার ভাই আর নেই। তিনি আর বেঁচে নেই।’
শিবলী গণমাধ্যমকে বলেন, আজও তানপুরা নিয়ে তার বড় ভাই সংগীত চর্চা করেছেন। সন্ধ্যার পর হঠাৎ দেখেন ঘরের দরজা বন্ধ। তখন দরজা ভেঙে তাঁর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি মৃত্যুঞ্জয় দে সজল নাগরিক নিউজকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা, শিল্পী সাদি মহম্মদ আত্মহত্যা করেছেন। বর্তমানে তার লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্ত হবে কিনা সেটার সিদ্ধান্ত (রাত ১১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত) এখনো হয়নি। ময়নাতদন্ত হলে তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হবে।’
মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তোফাজ্জল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, বাসায় যে ঘরে বসে সাদি মহম্মদ গান করতেন, সেখানেই তার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেছে। মনে হচ্ছে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। বাসার লোকজন ডাকাডাকি করে তার সাড়া পায়নি। পরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। খবর পেয়ে রাত ৮টার দিকে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে।
সাদি মহম্মদের বাবা সলিমউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ হন। ১৯৭১ সালে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার।
ওই বছরের ২৩ মার্চ বাড়িতে সাদি মহম্মদের আঁকা বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান সলিমউল্লাহ। সেই পতাকা ওড়ানোর সূত্র ধরে ২৬ মার্চ অবাঙালি বিহারি ও পাকিস্তানি সেনারা বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়, গুলি করে মারা হয় সলিমউল্লাহকে।
সাদি মহম্মদ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। ২০০৭ সালে আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৯ সালে তার শ্রাবণ আকাশে ও ২০১২ সালে তার সার্থক জনম আমার অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগ এর পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা সলিম উল্লাহর বাড়িতে নিয়মিত বৈঠকে আসতেন দলের শীর্ষ নেতারা, আসতেন বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামালও।
একাত্তরের ২৩ মার্চ তাজমহল রোডের সেই বাড়িতে সেজ ছেলে সাদি মহম্মদের আঁকা বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান বাবা সলিমউল্লাহ, সেই পতাকা সেলাই করে দিয়েছিলেন সাদী-শিবলীর মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ।
সেই পতাকা ওড়ানোর সূত্র ধরে একাত্তরের ২৬ মার্চ অবাঙালি বিহারি ও পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে সলিমউল্লাহর বাড়ি। পুড়িয়ে দেয়া হয় পুরো বাড়ি, গুলি করে মারা হয় সলিমউল্লাহকে।
গত বছরের জুলাই মাসে সাদি মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ মারা যান। এরপর থেকেই নাকি নানা কারণে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন এই সংগীত তারকা।
সাদি মহম্মদ বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সর্বশক্তিমান তার সৃষ্টির মধ্যে বাস করেন। অন্যকে ভালোবেসে যে কেউ তার নেয়ামত পেতে পারেন। ফলে কেউ আমার সঙ্গে প্রতারণা করলে আমি মাথা ঘামাই না। আমার দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি প্রতারণা করেছে তিনি আসলে নিজের সাথে প্রতারণা করেছেন।’
বাবা-মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি মহম্মদ। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন বসাতে পারেননি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন ১৯৭৫ সালে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে পড়তে যান। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেই থেকে শুরু পথচলা।
বর্ষা ও বসন্তের গান পছন্দ করতেন সাদি মহম্মদ। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখার কথাও বলেছেন। উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের সিনেমা ছাড়াও হলিউডের ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’, ‘রোমান হলিডে’ ছিল তার বেশ পছন্দের। এ ছাড়া বই পড়তেন। প্রিয় লেখকদের একজন ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পছন্দ করতেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আধুনিক গানসহ সাদি মহম্মদের প্রকাশিত মোট অ্যালবামের সংখ্যা ষাটটিরও বেশি। ২০১৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন।
প্লেব্যাক করেছেন অসংখ্য সিনেমায় ও নাটকে। তিনি ২০১২ সালে চ্যানেল আইয়ের ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
তার মৃত্যুতে সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।