।। তাহসিন আহমেদ ।।
২৭ বছর আগের এই দিনে শুক্রবারে জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ ইন্তেকাল করেন। ১৯৯৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, রোববার, বাংলাদেশ বেতারে মাজহারুল ইসলামের উপস্থাপনায় নায়িকা শাবনূর আবেগী কণ্ঠে স্মরণ করেন সালমানকে।
বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে এক ধূমকেতুর মতো এসেছিল নায়ক সালমান। নায়ক সালমান শাহ যুগে যুগে চির অমর হয়ে থাকবে তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে।
-চিত্রনায়িকা শাবনূর
আজ ২৭ বছর পরেও প্রাণহীন সালমান নতুন প্রজন্মের কাছে এখনও জনপ্রিয়। সালমান শাহ’র ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শাবনূর আবেগী কণ্ঠের সেই বক্তব্য যেন প্রতিটি সালমান ভক্তের শূন্যতাকে ধারণ করে। বাংলা চলচ্চিত্র কতটা এগিয়েছে বা কতটা পিছিয়েছে সেই বিতর্কে যাব না কিন্তু সালমান থাকলে বাংলাদেশের সিনেমা জগত অন্তত পাশের দেশের চলচ্চিত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারত। কতটা প্রাসঙ্গিক হলে মৃত্যুর এত বছর পরেও তিন প্রজন্মের কাছে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা নিয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় স্থান পাওয়া যায় তার নজির চিত্রনায়ক সালমান শাহ। ৭০’র দশক, ৮০’র দশক, ৯০’র দশক এমনকি বর্তমান প্রজন্মের কাছেও সালমান শাহ’র চলচ্চিত্র মানে আধুনিকতা, ভালো পারিবারিক গল্প কিংবা রোম্যান্টিক চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন।
গত ২৭ বছরে কম করে হলেও ১৬০০ ছবি মুক্তি পেয়েছে, এসেছে অনেক নায়ক কিন্তু সালমানের মত কেউ কী এসেছে? এই শুন্যতা বোধকরি প্রতিটি প্রজন্ম অনুভব করবে। তাই শাবনূরের মত বলতেই হয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের আকাশে এক ধূমকেতুর মতো এসেছিল নায়ক সালমান। নায়ক সালমান শাহ যুগে যুগে চির অমর হয়ে থাকবে তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে।
সালমান শাহ’র জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, রোববার সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায়। তার পিতার নাম কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী। স্কুলে পড়ার সময় সালমান শাহ বন্ধুমহলে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে পরিতি ছিলেন।।
১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লীগীতিতে পাস করেছিলেন। চলচ্চিত্রে আসার আগে ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট, বুধবার বিয়ে করেন তিনি। চলচ্চিত্রে আসার আগে তিনি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক ‘পাথর সময়’-এ একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সালমান শাহ’র অভিনয় জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে আরো বেশকিছু নাটকে অভিনয় করেন।
১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহানের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমা দিয়ে সালমান শাহ’র চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। এ সিনেমার মাধ্যমে মৌসুমীরও চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। সিনেমাটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। তারপর থেকে সালমান শাহকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়ে দর্শকের মাঝে অসম্ভব ক্রেজ সৃষ্টি করেন।
মৃত্যুর আগ ও মৃত্যুর পর এই সালমানের ক্যারিয়ারে সালমান শাবনুর জুটি ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি যে জুটি আমাদের উপহার দেয় একে একে মুখলেসুর রহমানের ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ ( ১৯৯৫ সালের ১১ মে ), দিলিপ সোমে’র ‘মহামিলন’ (১৯৯৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর), শাহ আলম কিরণের ‘বিচার হবে’ (১৯৯৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ) মতিন রহমানের ‘তোমাকে চাই’ (১৯৯৬ সালের ২১ জুন), বাদল খন্দকারের ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ (১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই ) , জাকির হোসেন রাজুর ‘জীবন সংসার’ (১৯৯৬ সালের ১৮ অক্টোবর) , এম এম সরকারের ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ (১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর) ‘ প্রেম পিয়াসী’ (১৯৯৭ সালের ১৮ এপ্রিল) , স্বপ্নের নায়ক – ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাই , শিবলি সাদিকের ‘আনন্দ অশ্রু’ (১৯৯৭ সালের ১ আগস্ট) , মতিন রহমানের ‘বুকের ভেতর আগুন’ (১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর) ছবিগুলো।
এই জুটির সবচেয়ে সুপার ডুপার বাম্পার হিট ছবি ছিল মুখলেসুর রহমানের ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ ছবিটি যা সালমান মৌসুমির ব্যবসায়িক রেকর্ড গড়া ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মতো রেকর্ড পরিমান ব্যবসা করেছিল এবং তোজাম্মেল হক বকুলের সর্বকালের সেরা ব্যবসা সফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবির কাছাকাছি ব্যবসা করা ছবি হিসেবে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত ‘ ও ‘ স্বপ্নের ঠিকানা’ ছবিগুলো তালিকায় যুক্ত হয়েছিল । সালমান শাবনুর জুটির বাদল খন্দকারের স্বপ্নের পৃথিবী , দিলিপ সোমের ‘মহামিলন’ ও মতিন রহমানের ‘তোমাকে চাই’ ও শাহ আলম কিরণের ‘বিচার হবে ‘ ছবিগুলো ছিল জীবিতবস্থায় সেরা সুপারহিট ছবি এবং সালমানের মৃত্যুর পর এই জুটির সেরা তিনটি ছবি ছিল শিবলি সাদিকের ‘ আনন্দ অশ্রু’, এম এম সরকারের ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ এবং জাকির হোসেন রাজুর ‘জীবন সংসার’ ছবিগুলো । অর্থাৎ ব্যবসা ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে ছবির সংখ্যায় সালমান মৌসুমি জুটির চেয়ে সালমান শাবনুর জুটি ছিল আরও বেশী সফল । তবে শফি বিক্রমপুরির ‘দেনমোহর’ ছবিটি যদি সালমান মৌসুমির শেষ ছবি না হতো তাহলে সফলতার দিক থেকে সালমান মৌসুমি জুটি হয়তো আরও অনেক অনেক বেশী সফল হতো যা সালমান মৌসুমি জুটির মুক্তিপ্রাপ্ত চারটি ছবির ব্যবসায়িক দিক ও দর্শকদের চাহিদার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে প্রমাণ পাওয়া যায় । সালমান শাবনুর জুটির চেয়ে সালমান মৌসুমি জুটিটি আমাদের চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা ও জনপ্রিয় রোমান্টিক জুটি রাজ্জাক কবরি জুটির পরপরেই স্থান পেয়েছিল এবং আজো সেই স্থান ধরে রেখেছে ।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর. শুক্রবার ইন্তেকাল করেন তিনি। যদিও এই মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেই রহস্য এখনও থেকে গেছে।
মরহুম সালমান শাহ’র মৃত্যুবার্ষিকীকে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। সেই সাথে সালমান হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে ১৯৯৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, রোববার বাংলাদেশ বেতারে শাবনূরের আবেগী কণ্ঠে উচ্চারিত বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলঃ
অডিও শুনতে ক্লিক করুন
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি নিদারুণ বেদনার দিন ৬ সেপ্টেম্বর। এ বেদনাবিধুর দিনে আজকের প্রজন্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছে। মাটির তারকা সালমান শাহ আজ আকাশের তারকা হয়ে আকাশেই চলে গেল।
অকালে চলেই যদি যাবে, তাহলে কেন এই সালমান-শাবনূর জুটি? ভক্তদের আমি একা কেমন করে বোঝাব, আর কোনো দিন নতুন কোনো ছবিতে সালমান-শাবনূরকে দেখা যাবে না। কে বলে সালমান নেই? কে বলে আমাদের প্রিয় নায়ক সালমান নেই? ওই তো, কত ছবির রুপালি পর্দায় আমি আছি, নায়ক সালমান শাহ আছে। কোটি ভক্তের মধ্যে নায়ক সালমানের স্মৃতি আমাকেও ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। ওর অসমাপ্ত ছবির কাজগুলো আমার কাছে মনে হয় একটি করে বেদনার পাহাড়। কত ছবিতে অভিনয়। ওর সঙ্গে হেসেছি, কেঁদেছি। কিন্তু বাস্তবে যে ওর জন্য আমাদের কাঁদতে হবে, ভাবিনি। বাস্তবে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছে প্রিয় নায়ক সালমান।
যদি কেউ কোনো দিন জাফলংয়ে সিলেটের চা বাগানে কিংবা জৈন্তা পাহাড়ে শুটিংয়ে যায়, নিশ্চয়ই তোমার কথা মনে পড়বে নায়ক সালমান। সুরমা নদীর পাড়ে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে সিলেটের পুণ্য মাটির সঙ্গে মিশে আছে আমাদের প্রিয় নায়ক সালমান।
তোমার আত্মার শান্তি হোক পবিত্র ভূমির স্পর্শে। নায়ক সালমান নেই—বিশ্বাস হয় না। এই পৃথিবীর বুকে নতুন কোনো ছবিতে অভিনয় করতে আর আসবে না আমাদের প্রিয় নায়ক সালমান। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের আকাশে এক ধূমকেতুর মতো এসেছিল নায়ক সালমান। আমি শাবনূর, আমার বিশ্বাস, নায়ক সালমান শাহ যুগে যুগে চির অমর হয়ে থাকবে তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে।
লেখক: সম্পাদক, নাগরিক.নিউজ
সালমানের শূন্যতা অপূরণীয়