:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
হামাস-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলায় নিহত বেড়ে ১০০০ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ইসরায়েলের প্রায় ৬০০ জন। ফিলিসরিয়েছে ৪০০ জন। আহত হয়েছে ২০০০ জন।
শনিবার সকালে শুরু হওয়া হামাসের হামলার ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় বন্দুকধারীদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
হামাসের হামলায় নিহতদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে ইসরায়েলি বাহিনীকে সহায়তা করছে ইসরায়েলের স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠী জাকা। এই গোষ্ঠীর একজন মুখপাত্র হেব্রু ভাষার গণমাধ্যমকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত ৬ শতাধিক ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন।
হামাসের বন্দুকধারীদের সাথে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চলমান যুদ্ধের মাঝেই মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছে জাকা। এদিকে, হামাসের হামলা তীব্র হওয়ায় গাজা উপত্যকা লাগোয়া ইসরায়েলি ভূখণ্ড থেকে নিজ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের সম্প্রচার মাধ্যম কান, চ্যানেল-১২, ইংরেজি দৈনিক হারেৎজ এবং টাইমস অব ইসরায়েল হামাসের হামলায় ইসরায়েলিদের হতাহতের এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যুর এই সংখ্যা নিশ্চিত করেনি।
শনিবার ভোরের দিকে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে আকস্মিকভাবে রকেট হামলা শুরু করে হামাস। এরপর হামাসের শত শত যোদ্ধা স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়।
লেবাননের হিজবুল্লাহর উত্তর ফিলিস্তিনে হামলা
লেবাননের হিজবুল্লাহ রোববার সকালে উত্তর ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়েছে। সকালে এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ জানায়, আমরা সেবা ফার্মস অঞ্চলে রকেট ও গোলা হামলা চালিয়েছি। এ সময় ইসরায়েলি সেনাদের তিনটি ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছে। আমাদের অধিকৃত ভূমি উদ্ধার ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে এই হামলা চালানো হয়েছে।
সেবা ফার্মস দক্ষিণ লেবাননের ইসরায়েলে অধিকৃত একটি অঞ্চল। এটি ইসরায়েলের উত্তরে অবস্থিত।
হিজবুল্লাহর হামলার তড়িৎ জবাব দিয়েছে ইসরায়েল। তারাও হিজবুল্লাহর ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি একটি ড্রোন সেবা ফার্মসে হিজবুল্লাহর একটি ঘাঁটিতে আঘাত করেছে।
এসব হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের কোনো খবর জানা যায়নি।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইসরায়েলের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে রকেট হামলা শুরু করে হামাস। রাত ১টা ১৫ মিনিটে হামাসের ইজ আদ্দীন আল-কাসিম ব্রিগেডস কমান্ডার মুহাম্মদ দাইস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন। তাদের এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় আল-আকসা ফ্লাড। আল-আকসা মসজিদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার জবাবে এই অভিযান শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হামাস। হামাসের দাবি, তারা ইসরায়েলের দিকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে।
হামাসের যোদ্ধারা প্যারাগ্লাইডে চড়ে আকাশ পথে, নদী ও স্থল পথে ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ করেছেন। অর্থাৎ তারা ইসরায়েলের গোয়েন্দা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। ইসরায়েলের অন্তত সাতটি গ্রামে তাদের সেনাদের সঙ্গে হামাসের যোদ্ধাদের বন্দুক যুদ্ধ হয়েছে। হামাসের যোদ্ধারা একটি পরিবারকেও জিম্মি করেছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েলের সেনারা।
শুক্রবার রাত দেড়টার সময় গাজায় বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েলের আইডিএফ। তাদের এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় সোর্ডস অব আইরন।
আইডিএফ হামলা শুরুর চার মিনিটের মাথায় হামাসের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
মন্ত্রীদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক শেষে নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, ইসরায়েলের প্রিয় জনগণ। আমরা কোনো অভিযান নয় যুদ্ধ শুরু করেছি।
ইসরায়েলের সর্বাত্মক হামলায় এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। তবে ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজার ১৪ তলাবিশিষ্ট একটা বেসামরিক ভবন ধ্বংস হয়েছে।
হামাসসহ ফিলিস্তিনি যোদ্ধা দলগুলোর কাছে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে রকেট লাঞ্চার। কারণ, এই অস্ত্রটি তুলনামূলক কম দামে সংগ্রহ করা যায় এবং নিরাপদ অবস্থান থেকে দূর-দূরান্তে হামলা করা যায়। এর আগে ২০১৪ সালেও ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে দেশটিতে সাড়ে চার হাজারের বেশি রকেট ছুড়েছিল হামাস।
২০০৫ সালে ইরান ও সিরিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র পেতে কিছু সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে একটি গোপন সরবরাহ লাইন স্থাপন করতে সক্ষম হয় হামাস। এই লাইনে মূলত তারা ইরান ও সিরিয়া থেকে রকেট লাঞ্চারের চালান নিয়ে আসত। এই গোপন সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কটি গাজার সঙ্গে মিসরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে স্থাপন করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সুড়ঙ্গগুলোর বিষয়ে বহুদিন কিছুই জানতে পারেনি।
তবে ২০০৭ সালে ইসরায়েলি বাহিনী ইরানে নির্মিত ফজর-৫ রকেট লাঞ্চারের একটি বিপুল চালান আটক করে। হামাসের যোদ্ধাদের জন্যই ওই চালানটি ফিলিস্তিনে যাচ্ছিল।
কো-অপারেশন অব ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ব্রডকাস্টের তথ্যমতে, ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারির মধ্যেও ‘জাহাজ থেকে উপকূল’ চোরাচালান এবং কালোবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ রকেট লাঞ্চার সংগ্রহ করে হামাস।
ঐতিহাসিকভাবেই হামাসের কাছে অস্ত্র পৌঁছানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট ছিল সমুদ্রপথ। এই পথে প্রায় সময়ই অস্ত্রভর্তি বক্স গাজার উপকূলে হামাসের জন্য রেখে যেত পাচারকারীরা। সমুদ্রে ইসরায়েলি নৌ পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্যেও ধারণা করা হয়, এই পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র জড়ো করেছিল হামাস।
এদিকে ইরান ও সিরিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও কালোবাজার এবং বিদেশি আরও কয়েকটি উৎস থেকে ফজর-৩, ফজর-৫ এবং এম-৩০২ রকেটসহ নানা ধরনের অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। অস্ত্র সংগ্রহের এই বৈচিত্র্য হামাসকে ইসরায়েলের সঙ্গে বড় ধরনের সংঘর্ষে যাওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
‘ফিলিস্তিনিদের ওপর দীর্ঘদিনের নিপীড়নের ফল এই ভয়াবহ যুদ্ধ‘
ফিলিস্তিনিদের ভূখন্ড অবৈধভাবে দখলের পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে আগেই ইসরায়েল সরকারকে জানিয়েছিলেন একজন ইসরায়েলি আইনপ্রণেতা। কিন্তু তাঁর কথা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার কর্ণপাত করেনি বলেই গতকাল শনিবার এমন ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা হয়েছে বলে আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন তিনি।
বামপন্থী হাদাশ জোটের নেসেট (ইসরায়েলের আইনসভা) সদস্য ওফার ক্যাসিফ আল জাজিরাকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার যদি ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার নীতি পরিবর্তন না করে তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে তিনি সতর্ক করেছিলেন। ১২০ সদস্যের নেসেটে হাদাশের চারটি আসন রয়েছে।
কাসিফ বলেন, ‘আমরা নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যেকোনো হামলার নিন্দা ও বিরোধিতা করি। অর্থাৎ, আমরা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যেকোনো হামলার বিরোধিতা করি। আমাদের অবশ্যই ইসরায়েলের চালানো আগের ভয়ানক আক্রমণ ও অবৈধ ভূমি দখলের বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
‘আমরা বারবার সতর্ক করেছি। পরিস্থিতি ভয়ানক হতে চলেছে এবং প্রত্যেকেই এর মূল্য দিতে হবে—প্রধানত উভয় পক্ষের নিরীহ নাগরিকদের। দুর্ভাগ্যবশত, ঠিক তাই ঘটেছে।’
কাসিফ আরও বলেন, ‘ইসরায়েল সরকার ফ্যাসিবাদী সরকার। ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নির্মুলকে সমর্থন দিয়ে উৎসাহ এবং নেতৃত্ব দেয়। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চলছে। ফিলিস্তিনিদের রক্তে এটা স্পষ্টভাবে দেয়ালে লেখা আছে। দুর্ভাগ্যবশত এখন ইসরায়েলিদেরও একই দশা হতে চলেছে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর মতে, ২০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি গাজার সীমান্ত অঞ্চল ছেড়ে হামাস-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের আরও ভেতরে গিয়ে জাতিসংঘের স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
ক্যাসিফ বলেন, ‘নেতানিয়াহু ইসরায়েলের নাগরিকদের মঙ্গল চায় না, অধিকৃত অঞ্চলের ফিলিস্তিনিরা দূরের কথা। তিনি শুধু ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহী। মামলা থেকে রেহাই পেতে শুধু জেলের বাইরে থাকতে চায়। এটিই একমাত্র প্রেরণা ও উদ্দেশ্য।’
ইসরায়েলে সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা
ইসরায়েল ও হামাসের চলমান লড়াইয়ের কারণে ১০ জনের বেশি লোকজনের জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ।
এতে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর লড়াই অব্যাহত থাকায় সারা দেশের সব স্কুল আগামী দিনে বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ইসরায়েলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, দক্ষিণাঞ্চলের নেতানিয়া এবং মধ্যাঞ্চলের নেগেভে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শর্ত সাপেক্ষে খোলা রাখা যাবে। এই দুই এলাকার নিকটবর্তী বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে সাধারণ জনগণের যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা গেলেই কেবল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা যাবে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, বাড়ির বাইরে ১০ জনের বেশি মানুষের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি বাড়ির ভেতরেও ৫০ জনের বেশি মানুষ একত্রিত হতে পারবেন না।
জারি করা নতুন এসব নিষেধাজ্ঞা আগামী মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। হামাসের সঙ্গে তীব্র লড়াই অব্যাহত থাকায় এসব নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।