:: কে এম এ রাকিব ::
১৯৮৪ সালের ঘটনা।
পূর্ব ইউরোপের দেশ, যুগোস্লাভিয়ার আদালত এক লেখকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অবমাননার অভিযোগ আনে এবং এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়।
শাস্তির কারণ ছিল লেখকের একটা এফরিজম, যেখানে তিনি লিখছেন—
When our *father died did we realize he had abused us.
( যুগোস্লাভিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জোসিপ ব্রোজ। তিনি মার্শাল টিটো নামে বেশি পরিচিত)
জেল থেকে মুক্তির এক বছরের মাথায় এই লেখক বাক্যটা কিছুটা বদলায়ে লেখেন:
When our Father died, the court found he actually didn’t abuse us.
লেখক আবার গ্রেফতার হন। বিপরীধর্মী দুই বক্তব্যকে একই ধরণের অপরাধ সাব্যস্ত করা যায় না- এই যুক্তিতে, তাকে সেবার কারাদন্ড দেয়া যায় নাই।
সার্বিয়ান এই লেখকের নাম রাস্তকো জাকিচ। মেজাজে সিনিক্যাল ও নৈরাশ্যবাদী জাকিচ লেখেন মূলত স্যাটায়ার, কবিতা আর এফরিজিম। নব্বয়ের দশকে তার ওয়ানলাইলার সার্বদের মুখ মুখে ঘুরতো।
তার এফরিজমের নমুনা দিই—
১. এই দেশ থেকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দূরত্ব মাপা যায় কেবল আলোকবর্ষের হিসাবে।
২. যিনি তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে, তিনি কবরের বেশি নিকটবর্তী।
৩. মাথা নত করে, আমার স্যালারি উন্নত করছি।
রাস্তকো জাকিচের একটা কথা সার্বিয়াতে এখনও জনপ্রিয়; যেটা বলার জন্য তার পরিচয় দিলাম এবং উপরের ভনিতাটুকু করলাম। জাকিচ লিখছেন–
‘রাষ্ট্র নিজেই সার্কাস হয়ে উঠলে, প্রচুর বিনোদন সত্ত্বেও, পাবলিকের *** দিয়া রক্ত ঝরে।’
বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে পুরোদস্তুর সার্কাস হয়ে উঠতেছে, রবীন্দ্র সংগীত ‘বিকৃতি’র অভিযোগে পুলিশের কাছে হিরো আলমের মুচলেকা দেয়ার ঘটনা সেইটা আরেকবার দেখায়ে দিলো।
কিন্তু, হোয়াট ইজ হিরো আলম ফেনোমেনন?
সার্কাসে ঢোকার আগে, আসেন, হিরো আলম নিয়া সাম্প্রতিক হৈচৈটা বোঝার চেষ্টা করি।
হিরো আলমের বিরুদ্ধে একদল অতি-রবীন্দ্রপ্রেমীর অভিযোগ, হিরো আলম যথেষ্ট ‘রাবীন্দ্রিক মাখরাজ’ মেনে গান গায় না। তার উচ্চারণ সহীহ না, ‘বিকৃত’ উচ্চারণে গান গায়। অনেকের কাছে তারে ‘বেসুরো’ ঠেকে, বড় একটা অংশের কাছে তারে ‘ক্ষ্যাত’ লাগে।
এদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান বেসুরো গলায় গাওয়াও বিরাট অপরাধ, ব্লাসফেমি। অতি সংস্কৃতিমনা, এই গোষ্ঠীটাকে মোটাদাগে রবীন্দ্র-মৌলবাদী বলা যায়। তবে ভদ্রতাবশত আমি সেটা বলবো না।
কিন্তু এগুলা তো কাউরে গান না গাইতে দেয়ার অজুহাত হইতে পারে না।
সবার বিশ্বভারতী বা শান্তিনিকেতন কিংবা নিদেনপক্ষে ছায়ানট থেকে ট্রেনিং নিয়া ব্যাকরণ মেনে গান গাইতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা আরোপ গোয়ার্তুমি এবং এমনটা চাওয়া ফ্যাসিবাদী চাওয়া।
কারও গান ভাল না লাগলে সহজ সমাধান তার গান না শোনা। তার গান আমার খারাপ লাগলে বলতেই পারবো, চাইলে ট্রলও করবো।
অবশ্য ট্রল-ফান ইত্যাদির সীমা যে কতখানি এইটা নির্ধারণ করা কঠিন। সমাজ সহনশীল হইলে, সবকিছু নিয়া ট্রল করা যায়। সমাজ অথরিটারিয়ান হইলে, নিতান্ত নাম নিলেও চাকরি থাকে না; উলটা গুম-খুনের সম্ভাবনা থাকে।
এই অতি-রবীন্দ্রপ্রেমীদের সার্কাসে ফিরে আসবো;
তার আগে হিরো আলমের বিরুদ্ধে ‘বিকৃতি’র অভিযোগ বিষয়ে দুই-একটা কথা বলে নিই।
আপনিও একজন হিরো আলম যে প্রতিনিয়ত প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য নানা রকম মুচলেকা দিয়া চলেন। আত্মসম্মান নিয়ে দেশে সৎভাবে বাচতে চাইলে, দেখবেন, আপনার পদে পদে বিপদ।
কালচারে ‘বিকৃতি’ জিনিসটা কারও পক্ষে ডিফাইন করা অসম্ভব। কারণ কালচার ক্রমাগত বদলাইতে থাকা জিনিস। আর ‘বিকৃতি’ ডিফাইন করা সম্ভব না বলেই, ‘বিকৃতি’র অভিযোগের উছিলায় নোংরা পলিটিক্স করাও সবচে সহজ। এইটাই দেশে এখন ঘটতেছে ব্যাপক মাত্রায়। অতি রবীন্দ্র-প্রেমীরা যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতার বেশি কাছের লোক, হিরো আলমকে শায়েস্তা করা হইলো।
হিরো আলম বলছেন, ‘আমি আর জীবনেও রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত গাইবো না।’
হিরো আলম মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাইলেও একটা ‘মজার’ ব্যাপার কি জানেন?
আপনিও কিন্তু একজন হিরো আলম, যদিও তার মতো অতো ফ্যান-ফলোয়ার আপনার নাই।
আপনিও একজন হিরো আলম যে প্রতিনিয়ত প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য নানা রকম মুচলেকা দিয়া চলেন। আত্মসম্মান নিয়ে দেশে সৎভাবে বাচতে চাইলে, দেখবেন, আপনার পদে পদে বিপদ।
রাষ্ট্রের আব্বাদের চোখে, পাওয়ার এলিটদের চোখে, আপনার বেশিরভাগ কাজকর্মই বিকৃতিতে ভরা।
আপনার যে মুখের ভাষা, একসেন্ট, বা অনেকের ফেসবুকে লেখার ভাষাও কিন্তু দেশের প্রভাবশালী বড় অংশের কাছে বিকৃত ভাষা।
আপনার হয়তো চুল লম্বা কিংবা আপনার পোশাকও হয়তো ‘বিকৃত’। আপনি হয়তো ইয়ার্কি বা রসিকতা করতে চান, কিন্তু ‘আবহমান কাল’ ধরে গড়ে ওঠা চেতনার উপ্রে আঘাত লাগে; অথবা আপনি টিকটক করেন, যা ‘হাজার বছরের সংস্কৃতি’র সাথে বিট্রে করে, অর্থাৎ ‘বিকৃত’।
রাষ্ট্রের আব্বাদের যাবতীয় দুর্নীতি বা লুটপাট নিয়া ক্ষুব্ধ হওয়া বা জবাব চাওয়া তো দূর কি বাৎ, আপনি প্রশ্নও তুলতে পারেন না। আপনি কোনোমতে নিরাপদে থাকতে সবকিছুরে সেল্ফ সেন্সর করতে থাকেন৷
ওটাই মুচলেকা, ভায়া; –অপ্রকাশ্য ও অলিখিত মুচলেকা।
ফলে হিরো আলমদের ‘বিকৃত’ সুরে ও ভাষায় গান গাওয়ার অধিকার রক্ষা মানে আপনার নিজের অধিকারই রক্ষা করা৷
যাহোক, হিরো আলমের গান নিয়া অতি-রাবীন্দ্রিকদের সার্কাসে ফিরে আসি।
আমার হিরো আলমের গান ভাল্লাগে না। মনে হয়, কিছুই হয় না।
—কিন্তু কার চোখে হয় না?
—আমার চোখে।
বেশিরভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর গান আমার কাছে ন্যাকা-ন্যাকা, ঘুমপাড়ানি টাইপ লাগে। মনে হয়, কিছুই হয় না।
—কার কাছে ন্যাকা বা ঘুমপাড়ানি গানের মতো লাগে?
—আমার কাছে।
খেয়াল করেন, তবুও হিরো আলমের ক্ষেত্রে ট্রল করা যতটা সহজ, রবীন্দ্রনাথরে নিয়া সেটা তত সহজে বলতে পারবো না। প্রচুর দৌড়ানি খাইতে হবে।
ট্রল আইটেম হিসেবে হিরো আলমরা সবসময়ই সহজ বলির পাঠা৷ এখানে ভদ্রলোকদের ক্লাস ইস্যু আছে। পুরা ব্যাপারটা অনেকাংশে শ্রেণিবিদ্বেষ আর শ্রেণিরুচির মামলা।
কেইস ইন পয়েন্ট
হিরো আলমের রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া মানে যদি ‘বিকৃত’ করা হয়, কোক স্টুডিও বাংলা যে নজরুলের বুলবুলি গানটার মধ্যে একদম নতুন লিরিক যুক্ত করে গাইলো, —একই যুক্তিতে—, সেইটা আরও বেশি ‘বিকৃত’ হওয়ার কথা না?
অথচ বাস্তবতা তা নয়!
এই দ্বিচারিতার ব্যাখ্যা কিভাবে করবেন?
আমার টোটকা থিয়োরি নেন– গরিবের এন্টারটেইনার হিরো আলমেরটা হইতেছে ‘বিকৃত’ আর (মিক্লা ও উচ্চদের) কোক স্টুডিওরটা হইতেছে (ক্ষমতা ও টেকার কাছে) ‘বিক্রীত’।
কথা কি ঠিক, না বেঠিক?
চিল্লায়ে বলেন, মজলিশে হাজিরান!
এটা ঠিক রবীন্দ্রনাথ আর হিরো আলমকে তুলনা করা বেমানান। কিন্তু— হ্যা, একটা বিশাল কিন্তু!—ভায়া, রুচির ব্যাপারে কোনো কালে কোনো সমাজের লোকজন একমত হয় নাই। বেশিরভাগ চিন্তাবিদের মত হইতেছে, রুচি বিষয়ে একমত হওয়া আদৌ সম্ভব না। গ্রুদেব রবীন্দ্রনাথেরই কথা যে– ‘রুচির তর্ক শেষপর্যন্ত গায়ের জোরের তর্কে পর্যবসিত হয়।’
রুচি চিরঅমিমাংসিত এক বিষয়।
কোনো যৌক্তিক মীমাংসায় পৌছানো যায় না বলে, শেষপর্যন্ত রুচির ব্যাপারটা দাঁড়ায় মোটামুটি এমন—
নির্দিষ্ট কালে, নির্দিষ্ট সমাজে অধিপতি শ্রেণি তাদের পছন্দের যা কিছু ‘রুচিশীল’ বলে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ওই সমাজে সেটাই ‘রুচিশীল’ বলে পরিচিতি পায়। ইহা নিতান্ত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের মামলা।
এ কারণে আমি ‘রুচিশীল’ শব্দটা সবসময় ইনভার্টেড কমার মধ্যে রাখার পক্ষপাতী।
এবং সমাজ ও কালচার কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিবাদী যাতে না হয় সেজন্যে রুচির এবং বৃহৎ অর্থে সংস্কৃতির যত বেশি বৈচিত্র্য রাখা সম্ভব তত ভালো। কেবল এক ধরণের রুচির দাদাগিরি অসুস্থ সমাজের লক্ষণ।
এ কারণে আমি সবসময় কালচারাল এনার্কির পক্ষে।
এ কারণে আমি ইংরেজি, বাংলা, মাদ্রাসাসহ যেকোনো মিডিয়ামের লোকদের যেকোন ধরণের কালচারাল প্রডাকশনের অধিকারের পক্ষে৷
এ কারণে আমি প্যান-প্যানানি, ঘুমপাড়ানি রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার অধিকারেরও পক্ষে।
এ কারণেই, হিরো আলমের গান আমার না ভাল্লাগলেও, হিরো আলমদের গান ও অন্যান্য কাজকর্ম করার পূর্ণ অধিকারের পক্ষে।
আবার ঠিক এ কারণেই, আমি হিরো আলম বলেন বা রবীন্দ্র-নজরুল সবাইরে নিয়া ট্রল-রসিকতা কিংবা নানান রকম সার্কাসের অধিকারেরও পক্ষে৷ কারণ এতে সমাজের বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। বরং সমাজের বৈচিত্র বাড়ে।
কিন্তু খোদ রাষ্ট্রের নাগ গলানো এবং সার্কাস হয়ে ওঠার আমি ঘোর বিরোধী।
রাস্তকো জাকিচের কথাটা মনে আছে?
‘রাষ্ট্র নিজেই সার্কাস হয়ে উঠলে, প্রচুর বিনোদন সত্ত্বেও, পাবলিকের *** দিয়া রক্ত ঝরে।’
পুলিশরে মুচলেকা দিয়া হিরো আলমের চুপ হয়ে যাওয়ার অর্থ একজন ভাইরাল সেলেব্রিটিরে জাস্ট থামায়ে দেয়া না।
নাগরিক হিসেবে ক্রমাগত ‘টুট টুট’ খাওয়া থেকে আপনার আরও অধিকতর ‘টুট টুট’- খাওয়ার দিকে চলে যাওয়ার লক্ষণ।
সো, সাধু সাবধান!