:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
কওমি মাদ্রাসার মানোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমীর ও গাজীপুরের দেওনার পীর অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। হেফাজত নেতার এ চিঠি আমলে নিয়ে করণীয় নির্ধারণে সভাও ডাকা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
গত ২৫ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠি দেন হেফাজতের নেতা অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। ‘কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মানোন্নয়নকল্পে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ’ শীর্ষক চিঠিতে মিজানুর রহমান আটটি সুপারিশ করেন।
এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কওমি মাদ্রাসার বোর্ডপ্রধানদের একটি বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এরপরই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় কওমি আলেমদের মধ্যে। কোনো কোনো দায়িত্বশীল আলেম মনে করছেন, সরকারের অভ্যন্তরের কারো পরামর্শেই মিজানুর রহমান চৌধুরী এ প্রস্তাব দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া ‘কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ’ শীর্ষক চিঠিতে মিজানুর রহমান আটটি সুপারিশ করেন।
সুপারিশগুলো হচ্ছে:
১. কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষার মান উন্নয়নে আপনি (প্রধানমন্ত্রী) দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়ে সনদের ব্যবস্থা করেছেন এবং এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য জাতি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ওই আইনে কওমি শিক্ষার সূচনা অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের ভিত্তি উল্লেখ নেই, সাধারণ শিক্ষায় যেমনটি আছে। কওমি শিক্ষা আইনে এই বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাটি ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন ‘কওমি মাদরাসা সমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকর্মীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিস ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’এর ২(১) ধারায় ‘কওমি মাদরাসা’ এর সংজ্ঞায় বর্ণিত ‘কওমি মাদরাসা’ অর্থ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আত ও দারুল উলূম দেওবন্দের আদর্শ, মুলনীতি ও মত-পথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তার উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহির শিক্ষাকেন্দ্র;’ উক্ত ধারার সঙ্গে ‘যেখানে মক্তব, নাজেরা, হেফজ থেকে শুরু করিয়া দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত এবং তৎপর ইফতা, উলুমুল হাদিস, তাফসিরসহ উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হয়’ সংযুক্ত করা আবশ্যক।
২. কওমি ধারার শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যবস্থা। উহার শিক্ষক ও শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিটি শিক্ষকের বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। জাতীয়ভাবে বা ব্যক্তি উদ্যোগে ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা খুবই প্রয়োজন।
৩. যেহেতু কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে, সেকারণে মাদরাসার সকল প্রকার দান আয়কর মুক্ত থাকা দরকার। এই বিষয়ে পরিপত্র জারি করলে দাতারা উৎসাহের সঙ্গে কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করবেন।
৪. মাদ্রাসার নিজস্ব আয় থেকে শিক্ষক কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন, স্বল্প আয়ের শিক্ষকদের মাসিক বেতন নিয়মিত পরিশোধ করা, মেধাবি, এতিম, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা।
৫. কোনও সরকার প্রধানের উদ্যোগে একই সঙ্গে ৪৬০টি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ একটি বিশ্ব রেকর্ড বটে। উক্ত মসজিদ সমূহে ইমাম ও খতিব নিয়োগের ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসা থেকে পাস করা মেধাবি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদার অনুসারিদের ইমাম খতিব নিয়োগ প্রদানে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং নিয়োগ বোর্ডে স্থানীয় কওমি মাদ্রাসা থেকে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেন ভিন্ন মতাদর্শীরা নিয়োগ পেতে না পারে। তাহলে সরকারের প্রদত্ত স্বীকৃতি বাস্তবে আরও প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
৬. কওমি শিক্ষাঙ্গন এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্র শিক্ষক, কর্মচারীদের সকল প্রকার প্রচলিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৭. সকল কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেফাক ও হাইয়াতুল উলইয়া-র আওতাভুক্ত করে তার নীতিমালার আলোকে পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; যাতে ছাত্রদের পড়ালেখার মান নিশ্চিত করা যায়।
৮. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী মনে করেন, তার দাবি বাস্তবায়িত হলে এবং প্রতিটি কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে ব্যক্তি ও জাতি গঠনে কওমি মাদরাসাগুলো অনেক বেশি অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মাদক নির্মূল ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে তৃণমূল পর্যায়ে মাদরাসাগুলোর উলামায়ে কেরামের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
২৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করে ওই চিঠি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠান অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কওমি মাদ্রাসার বোর্ড প্রধানদের একটি বৈঠকের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
বৈঠক ডাকার পেছনে এই চিঠি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বৈঠকের মোটিভ হিসেবে এ আবেদনের কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।
উপসচিব মো. শামীম হাসান স্বাক্ষরিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে- গত বছর (২০২১) ২৬, ২৭, ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। এ বিষয় অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশের আলোকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং চলতি বছর গত ২৫ জুন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীরের পাঠানো চিঠির সুপারিশের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। হেফাজতের নায়েবে আমীরের চিঠিতে বাংলাদেশ কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে আটটি সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে আগামী ১০ আগস্ট (বুধবার) বেলা ১১টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে।
সভায় যোগ দিতে শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, এনএসআই মহাপরিচালক, ডিজিএফআই মহাপরিচালককে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি বেফাক, কওমি মাদ্রাসা বোর্ড গহরডাঙ্গা, ইত্তেহাদুল মাদারিস, আযাদ দ্বীনি বোর্ড, তানযীমুল মাদারিস, জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও মহাসচিবকেও বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, এটা একান্তই ব্যক্তিগত সুপারিশ। কোনো বোর্ডের আমি সদস্যও না, কারও সঙ্গে আমার কথাও হয়নি। এখন তারা যদি প্রয়োজন মনে করে, আমার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবেন। আমি বেফাক কিংবা হাইআতুল উলয়ার কোনো কমিটিতে নাই। যে কারণে তাদের কাছে উপস্থাপনের সুযোগ পাইনি। তবে হেফাজত নেতা হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে এ বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেয়নি। এ কারণে আমি মনে করি, এ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিতে পারবেন।