:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২২টি ভোটকেন্দ্রের প্রতিটিতে ৫০টিরও কম ভোট পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। নৌকা প্রতীকে ১০০টির কম করে ভোট পড়েছে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪১টি।
প্রায় ৬২ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে সরকারি দলের প্রার্থীর ভোটের সংখ্যা একশর ঘরে পৌঁছেনি। মঙ্গলবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২২৯টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হয়। এ নির্বাচনে ডালিয়া একটি কেন্দ্রে সর্বনিম্ন ১৩টি ভোট পেয়েছেন।
সর্বোচ্চ ২৫৪টি ভোট পেয়েছেন আরেক কেন্দ্রে। এ নির্বাচনে বৈধ ২ লাখ ৮০ হাজার ৩৬ ভোটের মধ্যে সরকারি দলের প্রার্থী ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন।
প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগের কম পাওয়ায় তার জামানত বাজেয়াপ্ত হতে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিজয়ী মেয়র জাতীয় পার্টির মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে সর্বনিম্ন ১২০ ভোট পেয়েছেন একটি কেন্দ্রে। অপর এক কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন ১২০৬টি। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ২২৯টি কেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
স্মরণকালের ইতিহাসে কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের জামানত বাজেয়াপ্তের ঘটনা ঘটেনি। বিএনপিবিহীন এ নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র জাতীয় পার্টির মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার কাছে দলীয় প্রার্থী হেরে যাবেন-এমনটি আগ থেকেই ধারণা ছিল। তবে তিনি চতুর্থ অবস্থানে যাবেন এবং জামানত হারাবেন তা কল্পনাতেও ছিল না। এ পরাজয়ের চেয়ে বেশি হতবাক হয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মো. আমিরুজ্জামান হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ৪৯ হাজার ৯৯২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসায়। তারা বলেন, দলের অনেক কাউন্সিলর জয়ী হলেও মেয়র প্রার্থীর এমন ফলাফলে প্রমাণিত হয়েছে-আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় খুশি দলটির নীতিনির্ধারকরা। অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসাকে রাজনৈতিক অশনি সংকেত মনে করছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ করা হয়। এ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৫২ দশমিক ৪২ শতাংশ পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। ২২৯টি কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকে এক লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হন তিনি। দ্বিতীয় হয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী। আর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী মো. লতিফুর রহমান মিলন হাতি প্রতীকে ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন।
কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা কোনো কেন্দ্রেই একশর কম ভোট পাননি। চারটি কেন্দ্রে তিনি ১২০ থেকে ২০০র মধ্যে ভোট পেয়েছেন। তিনি সবচেয়ে কম ১২০ ভোট পেয়েছেন বেনুঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ১২৪ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন এ কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি ৭৮৪ ভোট পেয়েছেন। বাকি ২২৫টি কেন্দ্রেই ২০০র বেশি ভোট পেয়েছেন। কামদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সর্বোচ্চ এক হাজার ২০৬ ভোট পেয়েছেন নবনির্বাচিত মেয়র। এ কেন্দ্রে পড়েছে এক হাজার ৮৮৫ ভোট। সেখানে সরকারি দলের প্রার্থী নৌকা প্রতীকে ১০৩ ভোট ও বিদ্রোহী প্রার্থী হাতি প্রতীকে ২১৬ ভোট পেয়েছেন।
বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও রংপুর মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির। এজন্য তিনি নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ধীরগতিতে ভোট নেওয়া হয়। এ কারণে অনেকেই বিরক্ত হয়ে ভোট না দিয়ে চলে গেছেন। নইলে জাতীয় পার্টির ভোট সংখ্যা আরও বেশি হতো। মোস্তফার প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট হিসাবে ৪২ কেন্দ্র ঘোরার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেকেই রাত ৮টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। জাতীয় পার্টি ও লাঙ্গলের প্রতি মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও তাদের ভালোবাসা আমাদের অভিভূত করেছে। এতেই আবারও প্রমাণ হয়েছে, জাতীয় পার্টি এখনো জনপ্রিয় একটি দল।
ফল বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের রংপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে মাত্র ১৩ ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী মো. লতিফুর রহমান মিলন তিন ভোট বেশি পেয়েছেন। তিনি পেয়েছেন ১৬ ভোট। আর বিজয়ী মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছেন সর্বোচ্চ ১৭৮ ভোট। এ কেন্দ্রে ৭১৮টির মধ্যে ভোট পড়েছে ২৭২টি। ভোট পড়ার হার ৩৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ৩৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। এদিকে নিজ কেন্দ্র জিএল রায় রোডে অবস্থিত লায়নস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রেও হেরেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। এই কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন ৯২ ভোট। অপরদিকে জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান পেয়েছেন ১৬৬ ভোট। এই কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান পেয়েছেন ১৪৪ ভোট।
এছাড়া ২২টি কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে ৫০টিরও কম ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া। একেকটি কেন্দ্রে ১৩টি থেকে ৪৮টি পর্যন্ত ভোট পেয়েছেন তিনি। এই ৫০টি কেন্দ্রে ৩৪ হাজার ৩৫৬ জন ভোটার থাকলেও ভোট পড়ে ২৪ হাজার ৪২৯টি। এর মধ্যে বৈধ ভোটের সংখ্যা ২৪ হাজার ৩৩৪টি। এ সংখ্যক ভোটের মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন ৮৪৩ ভোট। অপরদিকে এসব কেন্দ্রেই জাতীয় পার্টির প্রার্থী পেয়েছেন ১২ হাজার ৮৩১ ভোট। আর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পেয়েছেন দুই হাজার ৪৯৯ ভোট।
কেন্দ্রগুলো হচ্ছে
জাফরগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজ (পূর্ব ও পশ্চিম, দুটি কেন্দ্র); মান্থনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (দক্ষিণ ও পশ্চিম, দুটি কেন্দ্র); উত্তম স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিনশেড ও নতুন ভবন, দুটি কেন্দ্র); আমাশু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; আমাশু প্রগতি উচ্চ বিদ্যালয়; বাহাদুর সিংহ মাস্টারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; হরিরামমল ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও পূর্ব গিলাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৫০টিরও কম ভোট পাওয়া বাকি কেন্দ্রগুলো হচ্ছে-ভবানীপুর কেরামতিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; নিসবেতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (মহিলা); মনোহরপুর ধর্মঘট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (পুরুষ ও মহিলা, দুটি কেন্দ্র); দেওডোবা জামালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; বাবুখাঁ উচ্চ বিদ্যালয় (মহিলা-১); রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়; আজিজনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (মহিলা); রংপুর রোটারি প্রাথমিক বিদ্যালয়; ফকরকুঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মেকুড়া উচ্চ বিদ্যালয় (পুরুষ) ভোটকেন্দ্র। এছাড়া ১১৯টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৫০ থেকে ৯৯ ভোট পেয়েছেন। বাকি কেন্দ্রগুলোতে একশর বেশি ভোট পেয়েছেন এ দলের প্রাথী। সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনের চেয়ে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৪০ হাজার কম ভোট পেয়েছেন।