:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৪ কন্যাশিশু। এই সময়ে অপহরণ ও পাচার হয়েছে ১৩৬ জন এবং বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে দুই হাজার ৩০১ জন কন্যাশিশু।
৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য তুলে ধরেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। একই সঙ্গে সংগঠনটি এসব বন্ধে ১০টি সুপারিশ তুলে ধরেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২২ উপস্থাপনকালে ফোরামের পক্ষ থেকে এসব জানানো হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকা থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
জরিপের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, এ বছরের আট মাসে ১৮৬ জন হত্যার শিকার হয়েছে। ৭৬ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন বিশেষ শিশুও ছিল। গত আট মাসে যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছে ১৩ জন, তাদের পাঁচজন যৌতুক দেওয়ায় হত্যার শিকার হয়েছে। একই সময়ে আত্মহত্যা করেছে ১৮১ কন্যাশিশু।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেমের অভিনয় ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ৪৯ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৪৩ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) কন্যাশিশু এবং ৮৭ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া যৌন হয়রানির স্বীকার হয়েছে ৭৬ জন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে তিনজন। অপহরণ ও পাচার হয়েছে ১৩৬ জন। এছাড়াও ২৮ জেলায় গত আট মাসে দুই হাজার ৩০১ জন কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।
গত ৮ মাসে আত্মহত্যা করেছে ১৮১ কন্যাশিশু। এ সময়ে ১৮৬ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। একই সময়ে যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছে ১৩ জন, তাদের ৫ জন যৌতুক দিতে ব্যর্থ হওয়ায় হত্যার শিকার হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৪ জন।
এতে আরও বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা ২০(৩)-এ বলা হয়েছে, বিচারের জন্য ধর্ষণ মামলা প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে কাজ শেষ করতে হবে। তবে, আইনে থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না।
সভায় সংগঠনটির সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে কন্যাশিশুর জন্মকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয় না। ছেলেসন্তান জন্ম দেওয়াকে সামাজিকভাবে গৌরবের বিষয় ভাবা হয়। বিষয়টিকে তিনি কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে দেখছেন। এসব কারণে তারা শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ঝুঁকিতে রয়েছে।
এসব বৈষম্যমূলক আচরণ তুলে ধরা দরকার জানিয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংস আচরণ শুরু হয় একেবারে জন্মের সময় থেকে। তার মতে, অনেক সময় ভ্রূণ অবস্থা থেকেই সহিংস আচরণ হয়। এ থেকে সমাজকে বের করে আনার জন্য গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় ফোরামের পক্ষ থেকে ১০ সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
১. শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সব ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে হবে।
২. ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ নামে একটি আইন জরুরিভিত্তিতে প্রণয়ন করতে হবে।
৩. ঘটনার শিকার কন্যাশিশু ও নারীর পরিবর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে ও আইনের আওতায় আনতে হবে। এ সম্পর্কিত প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করতে হবে।
৪. উচ্চপর্যায়ের আইসিটি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় সব ধরনের পর্নোগ্রাফি সাইট বন্ধসহ পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
৫. কন্যাশিশু নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
৬. শিশু সুরক্ষায় শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠন করতে হবে।
৭. বাল্যবিয়ে বন্ধের লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষার বাজেট বাড়িয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কন্যাশিশু ও তাদের অভিভাবকদের এর আওতায় আনতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
৮. সাইবার সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা, জাতীয় বাজেটে সাইবার সচেতনতায় গুরুত্ব দেওয়া, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএসআরে সাইবার সচেতনতা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইবার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
৯. নির্যাতন বন্ধে বিদ্যমান আইনসমূহের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০. কন্যাশিশুর প্রতি সমাজের মনোভাব বদলাতে নারী-পুরুষ, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এবং পরিবার সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
অনুষ্ঠানে কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড.বদিউল আলম মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।