■ বিশেষ প্রতিবেদন ■
অপারেশন প্ল্যান (ওপি) অনুমোদন না হওয়ায় জুলাই ২০২৪ থেকে অদ্যাবধি টানা প্রায় এক বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কর্মরত অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি)-তে কর্মরত চিকিৎসকেরা। তারপরও চালিয়ে যাচ্ছেন সেবা কার্যক্রম।
১৯৯৯ সালে এইসপিএসপি প্রকল্পের অধীনে ৪৫জন ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক স্নাতক ডিগ্রিধারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রেজিষ্ট্রেশনপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতালে নিয়োগ করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে প্রচলিত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি সুপ্রাচীন, দেশজ ও হোমিও চিকিৎসা তথা ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকেও মূলধারায় যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে এইসপিএনএসপি প্রকল্পের ৩য় সেক্টর কর্মসূচির অধীনে ২২৬ জন এবং ২০২১ সালে ৪র্থ সেক্টর কর্মসূচির অধীনে ১১০জন কর্মকর্তার নিয়োগ সম্পন্ন হয় যেখানে ৩টি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক, মেডিকেল অফিসার, রেজিষ্ট্রার,সহকারী রেজিষ্ট্রার সহ জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’র মেডিকেল অফিসার পদ রয়েছে। ৩য় ও ৪র্থ সেক্টর কর্মসূচিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রায় এক বছর বেতন না হওয়ায়, প্রকল্পের মেয়াদ এখনও বর্ধিত না হওয়ায় এবং প্রকল্পের জনবল রাজস্বে স্থানান্তরিত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানসমূহে ভবিষ্যতে সেবা কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার্থী ও সেবা গ্রহীতারা।
সারা দেশে সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশ কিছু ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হলে সবার কথাতেই উদ্বেগ, উৎকন্ঠার ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, বরাবরই বেতন পাওয়ার আশ্বাস মিললেও কবে নাগাদ হতে পারে তার ধারণা কারও কাছে নেই। বেতন না পাওয়ায় পরিবার নিয়ে একরকম মানবেতর জীবনযাপনই করছেন তারা। এছাড়া জেলা সদর হাসপাতাল ,উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এএমসি’র চিকিৎসক থাকলেও সেবা গ্রহীতারা বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
“গত ১১ মাস আমাদের বেতন নেই। জীবন চালানো দায় হয়ে গেছে। আমাদের রাজস্বখাতভুক্ত করবে আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোন অগ্রগতি নেই। ২০১৪ সালে এই চাকুরিতে এসেছি। প্রায় ১১ বছরেও আমাদের চাকুরি স্থায়ী হলো না। অথচ আমাদের পূর্ববর্তী একই প্রকল্পের জনবল রাজস্ব স্থানান্তরিত হয়েছে। ১১ মাস বেতন বন্ধ থাকার পরও ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে অফিসে আসি, ক্লাস নিই। সরকার আমাদের মেধা, শ্রম ও কাজের অবমূল্যায়ন করছে।’’
প্রভাষক ডা. মোঃ নাজমুল হুদা, সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্ম এর মেডিকেল অফিসার (ইউনানী) ডা. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, পরিবার নিয়ে বেতন ছাড়া চলতে খুব সমস্যা হচ্ছে আমাদের। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম সেই ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে পাচ্ছি না। সবকিছু মিলিয়ে খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা। তিনি আরও বলেন, একবার শুনলাম এপ্রিলের শেষে বেতন হতে পারে। এখন জুন মাস চলে। বেতন কবে হবে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না কিছু।
এ বিষয়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ মাসুদার রহমান আকন্দ বলেন, ‘আমার এখানে একজন ইউনানী মেডিকেল অফিসার কর্মরত আছে। নিয়মিত অফিস করলেও তার বেতন ১১ মাস ধরে বন্ধ। তাদের বেতন হয় ওপির মাধ্যমে। চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনের ৩০ তারিখ। জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে পঞ্চম এইচপিএনএসপি পাস হওয়ার কথা, যা এখনো পাস হয়নি এবং কখন পাস হবে কেউ জানে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রাম এর আওতায় এএমসি নামক অপারেশনাল প্ল্যানের অধীনে ২০১৭-২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য প্রকল্পে ৮ম ও ৯ম গ্রেডে রেজিস্ট্রার, আরপি, প্রভাষক, মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছরের জন্য বাড়িয়ে জুন ২০২৪ পর্যন্ত করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর এসব কর্মকর্তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সুপারিশ করে তা বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার প্রকল্পের ডিপিএম ডা. মির্জা লুৎফর রহমান লিটন বলেন, অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার প্রকল্প শুধু একটি প্রকল্পই নয় বরং সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলায় কর্মরত ৩৫১ জন চিকিৎসক ও দেশের ২৮% চিকিৎসা সেবা গ্রহনকারী গনমানুষের স্বাস্থ্য সেবার একটি প্লাটর্ফম। দেশে ইউনানী ,আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে এই প্রকল্প ছাড়া আর তেমন কোন সরকারি উদ্যোগ নেই। তাই স্বাস্থ্য সেবার জনপ্রিয় এই প্রকল্পের সকল জনবলকে বিশেষ কারিগরি পদ বিবেচনায় রাজস্বখাতে স্থানান্তর করে দেশে ইউনানী ,আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থায়ী সমাধান করতে হবে।
সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ-কাম-অধীক্ষক ডা. মো. রাশিদুজ্জামান খান বলেন, “এটি একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হলেও এখানকার অধিকাংশ শিক্ষক প্রকল্পের জনবল। দুই বিভাগ মিলে মাত্র ৫ জন শিক্ষক রাজস্বের। তারাও ১-২ বছরের মধ্যে অবসরে যাবে। বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্প চলবে এবং এটাই সর্বশেষ প্রকল্প। বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নতুন করে আর কোন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না। তাই ২০২৬ সালের পর কি ভাবে চলবে এই প্রতিষ্ঠান? তাই এই জনবল সংকট নিরসনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা অভিজ্ঞদের রাজস্বখাতে স্থানান্তর করে এই সমস্যা সমাধান করা দরকার।”
সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রভাষক ডা. মোজাহিদ মিয়া বলেন, “সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমার শেষ প্রান্তে এসে ২০২১ সালে চাকুরিতে যোগদান করেছিলাম। গত প্রায় ১ বছর ধরে বেতন নেই আমাদের এই প্রকল্পের সহকর্মীদের। এখন অন্য চাকুরিতে যাওয়ারও সুযোগ নাই। আর এটি এখন শুধু আমাদের বেতনের বিষয়ই নয়। এটা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার অস্তিত্বের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজস্বে আত্তীকরণ করলে হয়তো তিনটি চিকিৎসা খাতকে এত সংশয়, সংকটে থাকতে হতো না।’’
সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রভাষক ডা. মোঃ নাজমুল হুদা বলেন, “গত ১১ মাস আমাদের বেতন নেই। জীবন চালানো দায় হয়ে গেছে। আমাদের রাজস্বখাতভুক্ত করবে আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোন অগ্রগতি নেই। ২০১৪ সালে এই চাকুরিতে এসেছি। প্রায় ১১ বছরেও আমাদের চাকুরি স্থায়ী হলো না। অথচ আমাদের পূর্ববর্তী একই প্রকল্পের জনবল রাজস্ব স্থানান্তরিত হয়েছে। ১১ মাস বেতন বন্ধ থাকার পরও ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে অফিসে আসি, ক্লাস নিই। সরকার আমাদের মেধা, শ্রম ও কাজের অবমূল্যায়ন করছে।’’
বেতন কবে নাগাদ হবে জানেন না খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার প্রকল্পের লাইন ডিরেক্টর ডা. মোঃ আবু জাহের। তিনি বলেন, ‘‘অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার প্রকল্পসহ আমাদের বিভিন্ন অপারেশন প্ল্যানের ২৫ হাজার কর্মী বেতন পাচ্ছেন না। কবে হবে সেটা বলাও মুশকিল। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় মোট ৩৮টি অপারেশনাল প্ল্যান আছে। এর মধ্যে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি) একটি যা পাঁচ বছর মেয়াদি। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ম সেক্টর কর্মসূচি হবে ২ বছরের জন্য। বর্তমান ডিপিপি অনুযায়ী এক্সিট প্লান তৈরি করে অত্যাবশ্যকীয় জনবল রাজস্বে স্থানান্তর করার কথা বলা হয়েছে।যেহেতু এটা সবশেষ প্ল্যান। এরপর রাজস্বখাতে যাবে। হয়তো এ অপারেশনাল প্ল্যান এতদিনে অনুমোদন হয়ে যেত, কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দেরি হচ্ছে। বিভাগের লোকজনের পরিবর্তন হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যক্তিও পরিবর্তন হয়েছে। নতুনরা এসে নতুন করে বুঝছেন।’’
এএমসি প্রকল্পে চিকিৎসকদের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে ফার্মাসিস্ট, পরিদর্শক (ইউনানী, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক), কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, হিসাব সহকারী, কম্পাউন্ডার পদেও নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এরাও দীর্ঘ দিন বেতনবঞ্চিত। চিকিৎসকদের সাপোর্ট স্টাফ কম্পাউন্ডার (২০২২ সালের নিয়োগ ব্যতীত) ও হার্বাল এসিস্ট্যান্ট এর পদগুলো রাজস্বে স্থানান্তরিত হলেও মূল চালিকাশক্তি চিকিৎসকদের পদগুলো (১৯৯৯ সালের নিয়োগ ব্যতীত) রাজস্বে স্থানান্তরিত হচ্ছে না। এই বৈষম্য দূর করে বকেয়া বেতন ও চাকুরী রাজস্বখাতে স্থানান্তর করে এই সেক্টরের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের।