আ. লীগ আমলে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।

শনিবার (২ নভেম্বর) দুপুরে ‘ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)’ ও ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ’ আয়োজিত বাংলাদেশের পাচার সম্পদের অযৌক্তিক ঋণ ও পুনরুদ্ধার বিষয়ক একটি সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন। সেমিনারের আয়োজন করে ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ব্যাংক খাত থেকে যে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার কথা বলেছেন, বাস্তবে তার পরিমাণ আরো বেশি। রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা ব্যাংক খাত ও বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছরে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে এর প্রকৃত হিসাব কোথাও নেই।

তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হলেও প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল। যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে সেই দেশের সঙ্গে আইনি চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে অর্থ পাচার ও দুর্নীতি বন্ধ হবে না।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থ পাচার রোধে রাষ্ট্রকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এ সময় সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বৈঠক করেছে সরকার। আগামী দুই বছরের মধ্যে যদি একটা পয়সাও ফেরত আসে তাহলে সেটাও বড় অর্জন হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি যারা চালু করেছেন, সেই প্রভাবশালীরাই পাঁচ তারকা হোটেলে বসে ব্যাংক খাতের নীতি পলিসি তৈরি করতো। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব পলিসি শুধু ঘোষণা করতো।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক এখন যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে, সেসব তথ্য-উপাত্ত আগেই তাদের হাতে ছিল। দুদক প্রমাণ করলো, যারা ক্ষমতায় আসছে বা আসবে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা যাবে না। সেই জন্য তাদের সংস্কার করা দরকার।

শুধু মুখের কথায় অর্থপাচার রোধ হ‌বে না জা‌নি‌য়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থপাচার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, এনবিআর, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, বিএফআইইউ—এসব প্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার পথনকশা আছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে, শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না। অর্থ পাচার রোধে বেশ কিছু আইনেরও প্রয়োজন আছে। এছাড়া দুর্নীতি বন্ধে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েস্ট সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া এবং আর্থিক অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব উদ্যোগ নিলে পাচার হওয়া টাকার পুরোটা না হলেও একটা অংশ উদ্ধার করা যাবে। এতে ভবিষ্যতে পাচার করার বেলায় সবাই সাবধান হয়ে যাবেন।

তিনি আরও বলেন, অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্থ স্থানান্তর ও অর্থ পাচার—উভয় পদ্ধতিতেই দেশ থেকে অর্থ সরানো হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে অনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়। অনুমান করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার পাচার করা হয়েছে।

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আইএমএফসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার দেওয়া ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তৎকালীন সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা ছিল না, ঋণ দিলে সে অর্থ জনগণের কাজে আসবে না—এসব জানা সত্ত্বেও আইএমএফ সরকারকে কেন ঋণ দিয়েছিল? এসব ঋণের টাকা শুধু অপব্যবহারই হয়নি, তা দিয়ে সরকার গুলি কিনেছে, বারুদ কিনেছে ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করেছে।

তিনি বলেন, গত সরকারের সময়ে বিভিন্ন উৎস থেকে যত ঋণ নেওয়া হয়েছে ও ব্যয় করা হয়েছে, সব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে স্বাধীন তদন্ত করতে হবে।

বিদেশি সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের ম‌ধ্যে বছরে ৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি রপ্তানি মাধ্যমে চলে গেছে।

আমাদের দেশে যারা বিদেশি নাগরিক কর্মরত আছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের আয়ের একটা উৎস বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই মাধ্যমে বছরে ৩ বিলিয়নের মতো অর্থ পাচার হচ্ছে।

আরেকটি মাধ্যম হলো বাংলাদেশ থেকে যারা বিভিন্ন দেশে কাজ বা পড়ালেখার জন্য যায়, তাদের বড় একটি অংশ অবৈধভাবে জিম্মি হয়ে ভিসা ও কাজের জন্য আর্থিক চুক্তি করে যায়। এই মাধ্যমে ২.২ বিলিয়ন ডলার চলে যায়। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রভাবশালীরা পাচার করা অর্থ হজম করে ফেললে তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো উদাহরণ হবে না। সে জন্য পাচারকারীদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাচারের বিষয়টি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।

গ্রিনওয়াচ ঢাকার এডিটর মোস্তফা কামাল মজুমদারের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন ওয়েস্ট সিডনি ইউনিভার্সিটির এমিরেটস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *