■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
মিয়ানমারে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে অন্তত ১৫০ জন নিহত এবং ২০০ জনের বেশি আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এই ভূমিকম্পের প্রভাবে মিয়ানমারের পাশের দেশ থাইল্যান্ডেও অন্তত আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৮ মার্চ) দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে মিয়ানমারের মান্দালয় শহরের কাছে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। ভূমিকম্পের মাত্রা ৭ দশমিক ৭ হওয়ায় এটি অত্যন্ত শক্তিশালী বিবেচিত হয়। ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল মাত্র ৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার বা ৬ মাইল। তুলনামূলকভাবে অগভীর হওয়ায় এটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। ভূমিকম্পের ১১ মিনিট পর ৬ দশমিক ৪ মাত্রার একটি আফটার শক রেকর্ড করা হয়। এর ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে।
মান্দালয়ে ভূমিকম্পের পর বহু ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের দ্রুত মান্দালয়ের প্রধান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
৪৫ বছর বয়সী দাউ ক্যি শুইন নামের এক ব্যক্তি জানান, ভূমিকম্পের সময় তাঁর তিন বছর বয়সী মেয়ে মারা যায়। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিচে যাই, কিন্তু সময়মতো পৌঁছাতে পারিনি। আমি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তার আগেই ইটের নিচে চাপা পড়ে সে মারা যায়।’ রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সাহায্য করার মতো কোনো সরকার নেই, পর্যাপ্ত ডাক্তারও নেই। আমি মরে যাব, কিন্তু আমি মরতে চাই না। দয়া করে সাহায্য করুন।’
চার বছর আগে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখন আরও ভয়াবহ হয়েছে।
মান্দালয় থেকে ৬০০ মাইল (৯৬৫ কিলোমিটার) দূরে থাইল্যান্ডের ব্যাংককেও ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে। সেখানকার রাস্তায় আফটার শকের আশঙ্কায় অনেক মানুষ জড়ো হয়।
ব্যাংককে একটি ৩০ তলা ভবন ধসে পড়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, নির্মাণশ্রমিক ও পথচারীরা নিরাপদ স্থানে দৌড়াচ্ছেন। উঁচু সড়ক থেকে তোলা ভিডিওতে ধুলার মেঘে ঢেকে যাওয়া এলাকা দেখা যায়। একজন উদ্ধারকর্মী জানান, এই ভবন ধসে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ব্যাংকককে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন এবং আফটার শকের ক্ষতি এড়াতে উঁচু ভবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাসিন্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশের ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর এখনো পাওয়া যায়নি। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় ও হো চি মিন সিটিতেও ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে বলে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ভিএনএক্সপ্রেস জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি। ২০১১ সালে মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন এবং শতাধিক ভবন ধ্বংস হয়েছিল।
মিয়ানমারে ২০২১ সালে নির্বাচিত অং সান সু চি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা। এর পর থেকে দেশটি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলছে। বর্তমানে দেশটির বড় অংশ দখলে রয়েছে এই বিদ্রোহীদের। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের ৩০ লাখের বেশি মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। আর দেশটির এক–তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন।
ভূমিকম্পে ইরাবতী নদীতে ভেঙে পড়ল ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সেতু
মিয়ানমারের ইরাবতী নদীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত একটি সেতু ভেঙে পড়েছে। আজ শুক্রবার ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে ৯১ বছরের পুরোনো আভা সেতু, যা পুরোনো সাগাইং সেতু নামে পরিচিত।
মান্ডালা ও সাগাইং অঞ্চলের মধ্যে ইরাবতী নদীতে ব্রিটিশরা এই সেতু নির্মাণ করেছিল।
আজ শুক্রবার দুপুরের দিকে শক্তিশালী ভূমিকম্পের সময় সেতুটি ভেঙে পড়ে।
মিয়ানমারের সাংবাদিকদের পরিচালিত থাইল্যান্ডভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর খবরে বলা হয়েছে, রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের সময় মান্ডালা, নেপিডো ও অন্যান্য এলাকার বেশ কয়েকটি ভবন ধসে পড়ে। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল সাগাইং শহরের কাছে।
ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ, ভারত, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও চীনে।
থাইল্যান্ডে ভবন ধসে ১১৭ জন আটকা
ভূমিকম্পে মিয়ানমারের পর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে থাইল্যান্ডে। রাজধানী ব্যাংককে ৩০ তলা একটি নির্মাণাধীন ভবন ধসে পড়েছে। ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে ১১৭ জন আটকা পড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাঁদের খুঁজে বের করতে কাজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছিল।
এ ঘটনায় ব্যাংককের গভর্নর চাদচার্ট সিত্তিপান্ত বলেন, ওই ভবনধসে তিনজন নিহত হয়েছেন। ভূমিকম্পের পর আরও পরাঘাত আসতে পারে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তবে আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন তিনি।
ব্যাংকক একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের সময় লোকজন ভয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকেই ছিলেন পর্যটক। কম্পনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে হোটেলের ছাদে সুইমিংপুল থেকে পানি উপচে নিচে পড়ছিল। অনেকেই সাঁতার কাটার পোশাক পরে হোটেল থেকে নিচে নেমে আসেন। গতকাল থাইল্যান্ডের শেয়ারবাজারের সব কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বাসিন্দা বুই থু বলেন, ‘আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম দেয়াল ফেটে যাচ্ছে। সুইমিংপুল থেকে পানি উপচে পড়ছে। চারদিক থেকে শুধু মানুষের চিৎকার ভেসে আসছিল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। খুবই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।’