:: আকাশ আনোয়ার ::
ছবিটা বাংলার, বাংলার ধনিক রাজ্য। সময়টা ১৬৮০ থেকে ১৭০৩ হলেও বাঙালির নিজের জগতে সে সময়কাল পূর্বাপর সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে। তখন আমাদের বাঙালি বলা হতো নাকি বাঙ্গাল, নাকি বাঙ্গালা ! ইতিহাসবিদরা ভালো বলতে পারবেন। সেই বাংলার একেবারে গোড়ার দিকের ম্যাপ এটি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মানচিত্র।
বাংলার অপ্রতীম নদী গঙ্গা মানচিত্রে প্রবাহমান বঙ্গোপসাগরে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্টদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল এ ম্যাপের একটি খসড়া, যা এ ম্যাপ প্রকাশের আগে কখনো জনসমক্ষে আসে নি। যদিও ম্যাপটি আমি দেখেছিলাম ২০২৩ সালের প্রথম ভাগে।
ছবিটির সত্ত্ব বোধ করি হাইড্রোগ্রাফার জন থর্নটন, জন কর্তৃক সেদিনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ছিল বাংলার এ গৌরব। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া আর্কাইভস, এটি প্রকাশ করেছিল নিশ্চয়ই বহু বছর আগে।
আজ যেমন বাঙালি দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে, যখনই আমি দুই মেরুর বাঙ্গালির সম্মিলনে গেছি, কথা বলেছি, সবাই নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন। সবার মনের আকুতি একই। বাংলার বিভাজন কেউ মানতে পারেন নি। হাজার বছর ধরে প্রবাহমান বঙ্গোপসাগর উপকূলে যে বাঙালি বসতি স্থাপন করেছিল তাদের প্রাণের দাবীকে দেশ ভাগের কর্ণধারেরা কর্ণপাত করেন নি। আর এ বিভাজনে আলাদা আলাদা হয়ে গিয়েছিল পরিবারগুলো। কেউ এপার ছেড়ে ওপারে, আবার কেউ ওপার ছেড়ে এপারে বসতি গেড়েছিল। তবুও ধরা ছোঁয়ার মধ্যে ছিল নিজেদের মধ্যে দেয়া নেয়া, পারস্পরিক আনাগোনা। কিন্তু যেদিন গোটা দেশ হিসাব বুঝে নিতে চাইল তখনই বাঁধল সমস্যা।
কাঁটাতারের বেড়ার আড়ালে সীমান্ত’র কত কান্না আজও বহমান, কত কান্নারা হারিয়ে গেছে, শোকের পাহাড় জমে জমে তা মিশেও গেছে বঙ্গোপসাগরে, এবং সে শোকগুলো ক্রমশ পৃথিবীর সকল জলের উৎস বেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সকল প্রান্তে। তবু আশা ছাড়েনি বাঙালি। নিঃসঙ্গ, নীরব সময়গুলোতে বুকের মাঝে জেগে ওঠে সেই সেদিনের সব আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নগুলো, কখনো গুমরে গুমরে কাঁদে, কখনো অশ্রু হলে জলে মেশে। সে মানুষ কখনো বা সব ছুঁড়ে ফেলে গঙ্গায় করে অবগাহন, এতে শরীর জুড়োয় বটে মনের জ্বালা কমে না। সে সব খণ্ডচিত্রগুলো লেখায়, কথায়, আলাপে, গল্পে, উপন্যাসে জমা হতে থাকে। আমরা বাস্তব জীবন থেকে চোখ ফেরালেই দেখি গল্প উপন্যাসগুলোও যেন বাঙালির, হাসি কান্না, আনন্দ বেদনায় লীন। একই ভাবে অন্য প্রান্তের সীমান্ত সেই একই কথা বলে, পাকিস্তান ভারত সীমান্ত’র বহু কান্নাও আমরা বাস্তব জীবন থেকে গল্প উপন্যাসে দেখেছি। শুধু কি তাই, নূতন নূতন দেশ সৃষ্টির ফলে সীমান্ত অঞ্চল গেছে বেড়ে, সে দেয়ালে চাপা পড়েছে কত হাসি-আনন্দ, কত দুঃখ বেদনা। একই দেশের মানুষ হয়েও নিজের রক্তধারার সম্মিলনেও কত বিপত্তি, কত বাঁধা।
কি করবে বাঙালি !
বিমান, দুর পাল্লার ট্রেন, বাস, সমুদ্রযান দিয়ে কি আর সে বাঁধা ডিঙ্গানো যায় ! যায় না ! তাই তো নানা উৎসবে, মেতে ওঠে বাঙ্গালি। যদি নববর্ষের উৎসবের মত সর্বজনীন উৎসব হত কথা ছিল না। কিন্তু বাঙ্গালি আবার দ্বিধা বিভক্ত নিজ নিজ ধর্মে কর্মে। ধর্মের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থগুলো বাঙালির মানস পটে দেয়াল গড়ে। প্রাণের বারতা পরস্পরকে লীন করে বটে, তবুও বোধ করি বাঙালির সে সব স্বার্থই বড়, সেই প্রাণে ধর্ম টেনে তাকে আরও দ্বিধাবিভক্ত করে দেয় বাঙালি। বাঙালির মিলন একদিন হবে কোন সন্দেহ নেই, আসন্ন সঙ্কট নিরসনে আগামী পৃথিবী নিশ্চয়ই নবতর কোন উৎসের সন্ধান করবে। আলাদা হবার আগে দুই জার্মানির বিভাজনে নিশ্চয়ই এমন কোন সঙ্কট ছিল, কিন্তু ওরা সঙ্কটগুলো সমাধান করেছে, বাঙ্গালিও পারে সে ভাবে এসব সঙ্কট নিরসন করতে।
আমি নিশ্চিত একদিন বাঙ্গালি সে সব বাঁধার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলবে, যদি আগামীতে ভাঙেই তবে আজ কেন নয়, কেন আজ তাদের দ্বিধা, কেন সব পেয়েও সব হারাবার ভয়। বাঙ্গালিকে ভেবে দেখতে হবে, ভাবতে হবে আজ এবং সুন্দর আগামীর প্রয়োজনে। আজ এখানে শেষ করি, এ নিয়ে আবার লিখবো, এর মাঝে বন্ধুরা মতামত জানাতে পারেন। প্রত্যাশায় থাকবো।
অস্ট্রেলিয়া থেকে