দশ মাসে মবের শিকার হয়ে সারাদেশে ১৭৪ জনের মৃত্যু

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

গত ১০ মাসে মবের শিকার হয়ে ও গণপিটুনিতে সারাদেশে ১৭৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে সোমবার (২৩ জুন) পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৩ জন। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এই হিসাবের মতো পৃথক হিসাব দিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনও (এমএসএফ)। তাদের হিসাবে গত ৮ মাসে এ ধরনের ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১৫০ জন। আহত হয়েছেন ৩৬৩ জন। এমএসএফের হিসাবে ২০২৩ সালে এ ধরনের ১৪৩টি ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৬ জন।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, একের পর এক মবের ঘটনা ঘটলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সরকারের বিবৃতি ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণার পরও মব চলছে। 

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একাধিকবার মবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। খোদ পুলিশ সদস্যরা এখনও মবের শিকার হচ্ছেন। আসামি ছাড়িয়ে নেওয়া ও বেআইনি দাবিতে থানা ও পুলিশের যানবাহন ঘেরাও, হামলা করা হচ্ছে।  গত ১০ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৪৭৭টি মামলা হয়েছে।

পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৪, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭, মার্চে ৯৬, এপ্রিলে ৫২ ও মে মাসে ৬২টি। এই পরিসংখ্যান বলছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে। 

ভয়-ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন করার অভিযোগে নূরুল হুদা ছাড়াও সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রোববার দুপুরে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপি। মামলা দায়েরের কয়েক ঘণ্টা পর মব সৃষ্টি করে নূরুল হুদাকে হেনস্তা করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলের কিছু নেতাকর্মীর যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠে। 

গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন, ৫ আগস্টের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল, ন্যায্য শাসন দেখতে পাবে, অরাজকতা থাকবে না, কাউকে অসম্মান করা হবে না, সবাই ন্যায়বিচার পাবে। কিন্তু ১০ মাস পর এসে রোববারও একজন মানুষকে বর্বরভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে কোনো পক্ষ ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এতদিন পরও মব সন্ত্রাস বন্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। এসব ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশের উপস্থিতিতে মবের ঘটনা ঘটলে তো আর আইনের শাসন থাকল না। মব সন্ত্রাসে জড়িতরা কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী? নিশ্চয়ই না। তাহলে কোথা থেকে তারা ইন্ধন পাচ্ছে? মব বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলো কেন সরকারকে জোরাল তাগিদ দিচ্ছে না? এভাবে আবারও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে।

তৌহিদুল হক বলেন, ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, কে মবের শিকার হবে, কারা হামলা চালাবে, কে মামলা করবে, কে ভিডিও করবে– সব যেন পরিকল্পিত। তবে মব হলো সংক্রামক ব্যাধির মতো। এখনই এটাকে দমন করা না গেলে এমন পরিস্থিতির শিকার যে কেউ হতে পারেন।  
মানবাধিকার সংগঠন আসক এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ সংবিধান ও আইনি প্রক্রিয়া। বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যে কোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি-অধিকারই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিবৃতিতে বলা হয়, কেএম নূরুল হুদাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজের দৃশ্য শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং দেশের সংবিধান, মানবাধিকারের ন্যূনতম মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি আঘাতের নামান্তর।

আসক বলেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনায় কমপক্ষে ৮৩ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা একটি সভ্য রাষ্ট্রে ঘোরতর নৈরাজ্যের ইঙ্গিত বহন করে। 


মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার করতে হবে। বিচার ছাড়া মব বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। এ ধরনের আচরণ দেশের আইনি কাঠামো, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ। 

বিবৃতিতে এসব ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-র হিসাব অনুযায়ী, ‘২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২-২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ৯ মাসে মব মন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ২০২টি। এসব ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ২০২ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ছয় মাসেরও কম সময়ে (২৩ জুন) মব ভায়োলেন্সে প্রাণ হারিয়েছেন ৮৩ জন।

পারিবারিক বিষয়েও শুরু হয়েছে মব ভায়োলেন্সের প্রয়োগ। রবিবার ‘হিরো আলম’ রামপুরা উলন রোডে তার তৃতীয় স্ত্রীর বাসস্থানে লোকজন নিয়ে হাজির হন। নিজের স্ত্রী রিয়ামনির বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ তুলে তিনি হট্টগোল শুরু করেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ‘রিয়ামনি ও বার ড্যান্সার ম্যাক্স অভি রিয়াজকে হাতেনাতে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী’- এমন খবর প্রকাশিত হয়। পরে জামিনে মুক্তি পান রিয়ামনি ও ম্যাক্স অভি রিয়াজ

একই দিনে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে লালমনিরহাটে সেলুনের কর্মী পরেশ চন্দ্র শীল (৬৯) ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীল (৩৫)-কে প্রহার করে সেলুনে আটকে রাখা হয়। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে দুইজনকে আটক করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

৬ মে গুলশানে হেনস্তা করা হয় ভাস্কর রাসাকে। রিকসশা থেকে নামিয়ে হেনস্তা করে তার ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয়।

২০ মে রাতে ধানমন্ডির চার নাম্বার সড়কে মব তৈরি করে হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে৷ তবে সেখানে কঠোর ভূমিকায় ছিল পুলিশ৷ তিনজনকে আটক করা হয়। কিন্তু পরে এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদ তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান।

এর আগে ৫ মে বগুড়া হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস এম মিল্লাত হোসেনকে চেম্বার থেকে ধরে নিয়ে মারধরের পর পুলিশে সোপর্দ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র কিছু নেতা-কর্মী।

২৯ এপ্রিল অভিনেতা সিদ্দিককে রাস্তায় মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এই ঘটনার একাধিক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।ভিডিওতে দেখা যায়, জামা-কাপড় ছেঁড়া অবস্থায় তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একদল যুবক। কেউ কেউ তার গায়ে হাতও তুলছিলেন৷ অভিনেতা সিদ্দিককে তখন কাঁদতে দেখা যায়।

বিএনপির বিবৃতি
সাবেক সিইসি নূরুল হুদার ওপর মব সন্ত্রাসের ঘটনায় স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। মামলাটিও করেছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার অবমাননার সঙ্গে বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত করে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা মব কালচারে বিশ্বাস করি না, আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আদালতের রায় বাস্তবায়ন হবে, বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকবে।’

সালাহউদ্দিন আরো বলেন, ‘আমরা চাই, কোনো ব্যক্তি যত বড় অপরাধীই হোন না কেন, তার আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করার অধিকার যেন অক্ষুন্ন থাকে, তার আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার যেন ক্ষুণ্ণ না হয়।’

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। পুলিশ যেন জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। আর আমরা তদন্ত করে কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেবো।’

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘চোর সন্দেহে’ মারধরের শিকার হয়ে নিহত তোফাজ্জল হোসেন (৩২) বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম মৃত আবদুর রহমান। তিনি নিজ ইউনিয়নের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন। মা-বাবাহীন এই যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবি করেছেন তার স্বজন, প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক নেতা। ১৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ওই হলে চোর সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, তোফাজ্জলকে আটকের পর গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করেন। একপর্যায়ে তাকে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর করা হয়। রাত ১০টার দিকে হলের হাউস টিউটররা ঘটনাস্থলে গেলে রাত ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীরা সেখানে রেখেই চলে আসেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *