নলকূপের গর্তে পড়ে যাওয়া শিশু সাজিদ মারা গেছে

রাজশাহী প্রতিনিধি

রাজশাহীর তানোরে গর্ত থেকে উদ্ধার করা ২ বছর বয়সী শিশু সাজিদ বেঁচে নেই। তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথা জানিয়েছেন।

ভূগর্ভস্থ পানি তোলার জন্য তৈরি করা গভীর গর্তে পড়ে যাওয়া শিশু সাজিদকে ৩২ ঘণ্টা পর উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে শিশুটিকে উদ্ধারের পর তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।

তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাঈমা খান জানান, আজ বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) রাত ৯টা ৪০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাজিদকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর আগে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের রাত ৯টা ২ মিনিটে সাজিদকে অন্তত ৪৫ ফুট মাটির গভীর থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধারের পর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।

তিনি বলেন, আমরা শিশু সাজিদকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করি। বাচ্চাটির দেহ ধরার পর আমরাও কিছুক্ষণের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর পর জানতে পারি তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, এটি সাধারণ কোনো উদ্ধার অভিযান ছিল না। আগুন নেভানো বা পানিতে ডুবে যাওয়া উদ্ধারের চেয়ে এটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ। পাইপটির ব্যাস ছিল মাত্র ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন আবেগের বশবর্তী হয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করায় হিতে বিপরীত হয়েছে। তাদের চেষ্টার ফলে পাইপের ভেতরে প্রচুর মাটি ও খড়কুটো পড়ে যায়, যার কারণে শিশু সাজিদ মাটির নিচে চাপা পড়ে।

ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা এসে যখন সার্চ ভিশন ক্যামেরা প্রবেশ করাই, তখন ভিকটিমের কোনো অস্তিত্ব বা হাত-পা দেখা যাচ্ছিল না। শুধু মাটি ও খড়কুটো দেখা যাচ্ছিল। তখনই আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবুও শিশুটি বেঁচে থাকতে পারে-এ আশা নিয়েই আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা বা সেফটি বজায় রেখে কাজ করেছি।

তাজুল ইসলাম বলেন, উদ্ধার কাজে তিনটি এক্সকেভেটর ব্যবহার করা হলেও মূল পাইপের স্থানটিকে কম্পনমুক্ত (ভাইব্রেশন-ফ্রি) রাখতে যান্ত্রিক ও ম্যানুয়াল (হাতে খনন) পদ্ধতির সংমিশ্রণে ‘ইমপ্রোভাইজড’ কৌশলে কাজ করা হয়েছে।

উদ্ধার অভিযানে সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য তিনি উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, আনসার, সেনাবাহিনী, সাংবাদিক, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অরক্ষিত গর্ত ফেলে রাখার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রজেক্টের কাজ শেষে ছোট ছোট ‘লুপহোল’ বা গর্ত এভাবে অরক্ষিত রেখে যাওয়ার কারণে এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে, আজও ঘটল। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

গতকাল বুধবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে উপজেলার পাচন্দর ইউনিয়নের কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রামে মায়ের সঙ্গে বাড়ির পাশে বিলে যাওয়ার সময় পরিত্যক্ত গভীর নকলকূপে পড়ে যায় ওই গ্রামের রাকিবুল ইসলামের ছেলে সাজিদ।

৮ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের সরু গর্ত দিয়ে বেশ গভীরে চলে গিয়েছিল শিশুটি। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল এক্সাভেটর দিয়ে খনন শুরু করে। পাশাপাশি শিশুটির জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে।

কিন্তু এক পর্যায়ে আজ সন্ধ্যায় ৩৫ ফুট খননের পর মাটি জমে যাওয়ায় অক্সিজেন পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। শিশু সাজিদের বাঁচার আশা ক্ষীণ হয়ে আসে।

স্থানীয় লোকজন জানান, তানোরের কোয়েল হাট গ্রামে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এ এলাকায় এখন গভীর নলকূপ বসানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। এরপরও ওই গ্রামের এক ব্যক্তি তাঁর জমিতে পানির স্তর পাওয়া যায় কি না, সেটা যাচাই করার জন্য গর্তটি খনন করেছিলেন। সেই গর্ত ভরাটও করেছিলেন; কিন্তু বর্ষায় মাটি বসে গিয়ে নতুন করে গর্ত সৃষ্টি হয়। মায়ের সঙ্গে মাঠে গিয়ে শিশুটি সেই গর্তে পড়ে যায়।

বুধবার রাতে রাতে শিশু সাজিদের মা রুনা খাতুনকে গর্তের পাশ থেকে বাড়িতে নেওয়া হয়। গতকাল বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রুনা খাতুনকে নিয়ে বসে আছেন তাঁর মা শেফালী বেগম। শেফালী বেগম সাজিদের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। কাঁদতে কাঁদতে রুনা খাতুন বলেন, ‘গ্রামের কছির উদ্দিন তিন জায়গায় গভীর নলকূপ বসানোর জন্য গর্ত খুঁড়েছিল। দুই বছর ধরে বন্ধ না করে গর্তগুলো এভাবে ফেলে রাখেন। আমি কছিরের শাস্তি চাই, তাঁর বিচার চাই।’ তিনি জানান, ঘটনার পর কছির একবার দেখতে এসেছিলেন। তারপর আর আসেননি। তিনি পালিয়ে গেছেন।

তানোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কছিরের দেখা হয়নি। আমরা তাঁকে পাইনি।’ তাঁকে গ্রেফতার করা হবে কি না প্রশ্ন করলে ওসি বলেন, ‘তদন্ত চলছে। আমরা এটা দেখছি।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *