■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়। এই সংঘর্ষে উভয় কলেজের অন্তত ২ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন
বুধবার (২০ নভেম্বর) বিকাল ৩টার দিকে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। হামলা ও সংঘর্ষে আহত অন্তত ৩৬ জন ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে ভর্তি রয়েছেন।
সংঘর্ষ থামাতে কাঁদানে গ্যাস, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে প্রায় তিন ঘণ্টা পর বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। আহত ৩৬ জন চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালে বেশ কয়েকটি বাসসহ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। সংঘর্ষের কারণে মিরপুর-নিউমার্কেট সড়কসহ আশপাশের সব সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট।
গত মঙ্গলবার সায়েন্সল্যাব এলাকায় বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে সিটি কলেজের কয়েকজন ছাত্রের হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ছেড়ে দুটি বাস সিটি কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা বাস দুটি ভাঙচুর করে। এই খবর পেয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্ররাও দলবদ্ধভাবে সিটি কলেজে গিয়ে ভাঙচুর শুরু করে। এতে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাও দলবদ্ধ হয়ে বেলা ৩টার দিকে সায়েন্সল্যাব মোড়ের দিকে এগিয়ে এলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। তারা পরস্পরের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। দুই কলেজের এই শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ৪টার দিকে সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। প্রথমে ধাওয়া দিয়ে দুই পক্ষকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে তারা বেশ কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পুলিশের টিয়ার শেলে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজের ভেতরে ঢুকে পড়েন। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও। পরে তারা ক্যাম্পাসের ভেতরে অবস্থান নিয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর চড়াও হন। এ সময় কলেজের ভেতরে ঢুকে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। ক্যাম্পাসে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রবেশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আপত্তি জানালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাইরে চলে আসেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ছোট একটা হাতাহাতি ও গাড়ি ভাঙচুরকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টাধাওয়া ও মারামারি শুরু হয়। প্রথম দিকে পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করছিল। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠল যে শিক্ষার্থীদের হতাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা গেল। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়।
এদিকে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের এই সংঘর্ষের মধ্যে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে নিউমার্কেট ও চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের ফটকে তালা লাগিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। সংঘর্ষের কারণে মিরপুর-নিউমার্কেট, পান্থপথ, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্সল্যাব সড়কসহ আশপাশের প্রতিটি সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছতে দেখা গেছে তাদের। অনেকে কয়েকদিন পরপর কলেজ দুটির শিক্ষার্থীদের এমন কাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সংঘর্ষ চলাকালে শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকটি বাসসহ সড়কে থাকা গাড়িও ভাঙচুর করেন।
দুই কলেজের সংঘর্ষে অন্তত ২ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে। এর মধ্যে আহত ৩৬ জন শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আহতরা হলেন- ঢাকা কলেজের শাহরিয়ার (২১) মো. নূর হোসেন (২৪), মো. তুষার (১৮), মো. সেজান (১৮), রিফাত (২১), মো. আরাফাত (২১), নিরব (২১), শরিফ (২১), মো. ইয়াকুব (১৮), মো. মেহেদী হাসান (২১), আল-ইমরান (১৮), তানভীর (১৮), সুজন (১৮), মো. আরিফ (১৭), মহিউদ্দিন (২৩), তারেক (৩২), তাহসিন (১৮), ফয়সাল (১৮), অরিকুল তরিকুল ইসলাম (রাজীব) (২৫), মোহাম্মদ আলী (১৭) হাসান (১৮), ইসমাইল (১৮), ফাইয়াদ (১৮), মো. মাহির (১৭), সাকিন (১৮), তানভীর (১৮), তামিম (১৮), তাওফিকুর রহমান (১৭), আশিক (১৮), রাজ (১৮), মেহেদী (১৮), শিশির (১৮), মো. আশিকুল (১৫), তাওসিফ (১৯), তোহা (১৮) ও শিহাব (১৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনিম (২১)।
সংঘর্ষ এড়াতে সিটি কলেজ সরিয়ে অন্য স্থানে নেওয়াসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা কলেজ অডিটরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা কলেজ শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আ ক ম রফিকুল ইসলাম বলেন, এই সংঘর্ষে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষক আহত হয়েছেন। ঢাকা কলেজের স্থাপনায় সেনাবাহিনী সরাসরি হামলা ও ভাঙচুর করেছে, যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এ হামলায় জড়িত প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা, যারা এই হামলার নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের পদত্যাগ করতে হবে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ক্যাম্পাসে এসে পরিদর্শন করতে হবে। এ সময় উপস্থিত শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া, সেনাবাহিনী ভুয়া’ স্লোগান দেন।
তিনি আরও বলেন, ইতঃপূর্বে সকল বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সিটি কলেজের কতিপয় সন্ত্রাসী শিক্ষার্থী দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এবং পরবর্তী সংঘর্ষ এড়াতে সিটি কলেজকে এখান থেকে স্থানান্তর করতে হবে। সিটি কলেজের যেসব শিক্ষক এই নিন্দনীয় ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ও নির্দেশদাতা, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
আ ক ম রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা কলেজের সাত শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন এবং শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাই পরিকল্পিতভাবে ঢাকা কলেজের ১৮৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হামলা করে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যাতে সরাসরি সিটি কলেজ ও পুলিশ জড়িত।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা যখন কলেজের ভেতরে ঢুকে পড়েন এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তি চাই।
অন্যদিকে ঢাকা সিটি কলেজ অধ্যক্ষ কাজী নিয়ামুল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আমাদের প্রায় ৩৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়াও আরও ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। কলেজ থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীরা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, গত অক্টোবরের শেষ দিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে অপসারণের দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নামেন সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এই ঘটনায় টানা ২০ দিন বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার থেকে কলেজটির শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর এক দিনের মাথায় ঢাকা কলেজের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা।