ডিপি ওয়ার্ল্ডের ২১ ভারতীয় কর্মকর্তা চট্টগ্রাম বন্দরে

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ইজারা ইস্যু ঘিরে চট্টগ্রামে উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে ডিপি ওয়ার্ল্ডের ৩৪ জন কর্মকর্তার এনসিটিতে প্রবেশ করা নিয়ে, যার মধ্যে ২১ জনই ভারতীয় নাগরিক।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এনসিটির ইজারা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এখনো ‘গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট’ (জিটুজি) ভিত্তিতে প্রস্তাব বিবেচনার পর্যায়ে থাকলেও ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তারা টার্মিনালের ভেতরে ঢুকে কার্যত পর্যবেক্ষণ ও ‘প্রাথমিক দখলদারি’র আচরণ শুরু করেছেন। এর ফলে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা এবং চাকরি হারানোর আতঙ্ক।

শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, এনসিটির মতো একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হস্তান্তরের আগে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার বলেন, “ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এখনো ইজারা দেওয়া হয়নি। অথচ তাদের কর্মকর্তারা বন্দরের ভেতরে ঘোরাফেরা করছেন। ভবিষ্যতে যাতে তাদের আর দেখা না যায়, আমরা সেই হুঁশিয়ারি দিচ্ছি।”

ডিপি ওয়ার্ল্ডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তানভীর হোসাইন গত ১৫ এপ্রিল বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানের কাছে গেটপাস চেয়ে আবেদন করেন। পরদিনই বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের এনসিটিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এই প্রতিনিধি দলে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন ২১ জন, বাকি সদস্যরা দক্ষিণ আফ্রিকা, আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ফিনল্যান্ডের নাগরিক।

চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের প্রধান সমন্বয়ক মো. ইব্রাহিম খোকন বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, বিদেশি অপারেটর ও সাইফ পাওয়ারটেক কাউকে চাই না। এটি দেশের সম্পদ, কোনো একক স্বার্থের বিষয় নয়।”

তিনি আরও জানান, ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ টার্মিনালের অভ্যন্তরে গিয়ে বলছেন, “এই কক্ষটি আমার দরকার হবে।” কেউ আবার যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে জেনে নিচ্ছেন, বর্তমান কর্মীরা তা পরিচালনা করতে সক্ষম কি না। এর ফলে কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা সরকারকে ১৬ জুন পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে বিদেশি অপারেটরকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল না হলে ২২ জুন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চার ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করব।”

চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ৮,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালটি চালু হয় ২০০৭ সালে। দেশের মোট কন্টেইনার পণ্যের প্রায় ৫৫ শতাংশ এই টার্মিনালের মাধ্যমে ওঠানামা করে। টার্মিনালটি আধুনিক যন্ত্রপাতিসম্পন্ন ও অত্যন্ত লাভজনক—বছরে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দেয়।

তারপরও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় টার্মিনালটি বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিল। এমনকি পিপিপি কর্তৃপক্ষ ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার পর্যন্ত নিয়োগ করেছিল। তবে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই উদ্যোগ পুনরায় বিবেচনায় নেয়। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক মহলে প্রতিবাদ শুরু হয়।

বর্তমানে এনসিটি পরিচালনায় সাইফ পাওয়ারটেকের মেয়াদ আগামী ৬ জুলাই শেষ হচ্ছে। কে দায়িত্ব নেবে, তা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে পরবর্তী করণীয় জানতে চেয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি।”

বিশ্লেষকদের মতে, ২১ জন ভারতীয় কর্মকর্তার একসঙ্গে বন্দরের অভ্যন্তরে ঢোকা কেবল কারিগরি পর্যবেক্ষণের নাম করে হলেও ভূ-রাজনৈতিকভাবে তা স্পর্শকাতর একটি ঘটনা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপড়েন এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাচ্ছে।

সরকার শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয়—বিদেশি অপারেটর দিয়ে এনসিটি পরিচালনার পথে এগোবে, না কি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাখবে—তা এখন সময়ের অপেক্ষা। তবে ১৬ জুন এবং ২২ জুন—এই দুটি দিন চট্টগ্রাম বন্দর পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ মোড় আনতে পারে।

উল্লেখ্য, ডিপি ওয়ার্ল্ড একটি বৈশ্বিক বন্দর পরিচালনাকারী সংস্থা, যা ২০০৫ সালে দুবাই পোর্ট অথরিটি এবং দুবাই পোর্টস ইন্টারন্যাশনাল-এর একত্রীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ডিপি ওয়ার্ল্ডের ছয়টি মহাদেশের ৪০টি দেশে ৫০টিরও বেশি ব্যবসায় সমর্থিত ৭৭টি পরিচালনাগত সামুদ্রিক এবং অভ্যন্তরীণ টার্মিনালগুলির একটি পোর্টফোলিও রয়েছে।

বিশ্বের দুই শীর্ষস্থানীয় বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং এপি মুলার-মায়ারস্ক বাংলাদেশের শিপিং শিল্পে বড় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা বঙ্গোপসাগরের উপকূলে নতুন বন্দর নির্মাণ এবং বাংলাদেশকে একটি বৈশ্বিক রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে চায়।

গত ২৩ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম সামিট চলাকালে ডিপি ওয়ার্ল্ডের গ্রুপ চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম ও এপি মুলার-মায়ারস্কের চেয়ার রবার্ট মায়ারস্ক উগলা বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং এ প্রস্তাব দেন।

ডিপি ওয়াল্ডের সিইও জানান, তারা চট্টগ্রাম বন্দরের কনজেশন কমাতে এবং দূষণ হ্রাসের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা বাড়াতে নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগ করতে চান।

সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক এই লজিস্টিক কোম্পানির সিইও জোর দিয়ে বলেন, নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগ বাংলাদেশকে আরও বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এবং দূষণ কমাতে সহায়তা করবে।

ডিপি ওয়ার্ল্ডের সিইও উল্লেখ করেন, তারা ২০২২ সালেও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, তবে তখনকার সরকার তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

তিনি আরও জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে একটি ডিজিটাল অনলাইন কাস্টমস প্রক্রিয়া চালু করতে চান, যা দুর্নীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সাহায্য করবে।

তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশে ইনলাইন কনটেইনার ডিপোতেও বিনিয়োগ করতে চান।

প্রধান উপদেষ্টা সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েমকে জানান, বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরকে আরও দক্ষ করতে চায় এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলে আরও বন্দর নির্মাণ করতে চায়।

‘আমাদের এটা করতে হবে কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। আমরা অঞ্চলটিকে বৃহত্তম বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই,’ বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারিতা বাড়াতে চায়, কারণ দেশটি মনে করে এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যসমূহ, নেপাল এবং ভুটানের মতো দেশের কনটেইনার পরিচালনার জন্য একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হতে পারে।

‘আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে কারণ সময়েরও একটা মূল্য রয়েছে,’ বলেন প্রধান উপদেষ্টা।

ডেনমার্কভিত্তিক এপি মুলার মায়ারস্ক চেয়ার রবার্ট মায়ারস্ক উগলা জানান, তারা চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগ করতে চান এবং তাদের কারিগরি সহায়তায় এটিকে একটি সবুজ বন্দর হিসেবে রূপান্তরিত করতে চান।

রবার্ট মায়ারস্ক উগলা বলেন, তারা মরক্কো এবং ওমানেও একই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তাদের বিনিয়োগের মাধ্যমে ওমানের সালালাহ বন্দর বিশ্বের সেরা বন্দরের একটি হয়ে উঠেছে বলে প্রধান উপদেষ্টাকে জানান উগলা।

প্রধান উপদেষ্টা ডিপি ওয়ার্ল্ড ও এপি মুলার-মায়ারস্কের কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *