আইনজীবী আলিফ হত্যায় অংশ নেন ২৫ জন

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■  

চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মিশনে ২৫ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে ২৩ জনই কোতোয়ালি থানার বান্ডেল সেবক কলোনির বাসিন্দা। সেবক কলোনিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বসবাস করেন। সেবক কলোনির পাশেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

কোপানো ও পেটানোর পর নিথর হয়ে পড়ে ছিল আলিফের দেহ। তাঁর শরীরে অন্তত ৩০টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গভীর ক্ষত রয়েছে পাঁচটি। এতে তাঁর ডান কানের একাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় আরও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর ৩৭ অনুসারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তদন্তকাজে যুক্ত পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রঙ্গম কনভেনশন হলের পাশে এসি দত্ত লেনে শুরুতে ইটপাটকেল ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে জড়ো হয় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীরা। এক পর্যায়ে ধাওয়া দিয়ে চিন্ময় অনুসারীদের এসি দত্ত লেনের শেষ মাথায় নিয়ে যান আইনজীবী ও সাধারণ মানুষ। পরে সেবক কলোনি থেকে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন বের হয়ে পাল্টা ধাওয়া দিলে আইনজীবীরা গলি থেকে পেছনে সরে আসেন। এ সময় নিলয় সুজন ভবনের পাশে পা মচকে পড়ে যান আইনজীবী আলিফ। তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন লাঠিসোটা, কাঠের বাটাম দিয়ে পেটানো হয়। রক্তক্ষরণ ও পিটুনিতে নিথর হয়ে যাওয়ার পরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁকে কোপ দিতে দেখা যায় সেবক কলোনির চন্দন ও বুঞ্জাকে।

হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা হলো– কোতোয়ালি থানার বান্ডেল সেবক কলোনির নাং কিশোরের ছেলে বিধান, পেয়ারের ছেলে রনব, জগন্নাথ দাস ঝর্ণার ছেলে বিশাল ও বিকাশ, সেবক কলোনির রাজকাপুর, মোহনের ছেলে লালা, মাধের ছেলে সামির, সেবক কলোনির সোহেল দাস, শংকরের ছেলে শিব কুমার, সেবক কলোনির বিগলাল, মুকেশের ছেলে পরাশ, শেরীপের ছেলে গণেশ, লাবু লাল সরদারের ছেলে ওম দাস, দোশীর ছেলে পপি, সুরেশের ছেলে অজয়, সেবক কলোনির দেবী চরণ, শেরীপের ছেলে দেব, মৃত ধারীর ছেলে চন্দন, বিহারির ছেলে জয়, মনোরঞ্জনের ছেলে রমিত, মনছুরের ছেলে বুঞ্জা, সেবক কলোনির লালা, আশরাফ আলী রোডের সেবা সংঘ এলাকার ওমকার দাস, নন্দনকানন ১ নম্বর গলির মৃত খোকনের ছেলে রুবেল সাহা ও পটিয়া উপজেলার ধলঘাট আলমপুর গ্রামের কালীবাড়ির শুভ কান্তি দাস।

দুটি ছবিতে সিলভার রঙের হেলমেট, কমলা রঙের টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা রামদা হাতে এক যুবক এবং লাল হেলমেট, ব্লু রঙের টি-শার্ট ও জিন্স পরা বঁটি হাতে আরেক যুবককে কোপাতে দেখা যায় আলিফকে। সে সেবক কলোনির মৃত ধারীর ছেলে চন্দন বলে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। অন্যজন মনছুরের ছেলে বুঞ্জা মেথর।

তদন্তে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ২৫ জনকে শনাক্ত করেছি। তাদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে আনা হলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হবে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নাকি তাৎক্ষণিক ঘটেছে– তাও বের করা সম্ভব হবে।’ 

আলিফের ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত এবং উপস্থিত লোকজনের তথ্য অনুযায়ী, আলিফের পিঠে ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের পাঁচটি গভীর ক্ষত রয়েছে। এ ছাড়া আঘাতের ক্ষত রয়েছে ৩০টির অধিক। ময়নাতদন্তে সহায়তাকারী এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাথায় ধারালো অস্ত্রের তিনটি গভীর ক্ষত আছে। তাঁর ডান কানের একাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় উপস্থিত থাকা নিহতের বন্ধু আইনজীবী রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ‘তাঁর শরীরের এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে ক্ষত হয়নি। তাঁকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ক্ষতস্থানগুলো কালো হয়ে আছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’ 

চিন্ময়কাণ্ডে কোতোয়ালি থানার ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরীকেও বদলি করা হয়েছে। তাঁকে ডিবি বন্দরে পাঠিয়ে নতুন ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নগর পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক আবদুল করিমকে। গতকাল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ এ আদেশ দেন। এর আগে বুধবার রাতেই সিএমপি দক্ষিণ জোনের উপকমিশনার লিয়াকত আলী খানকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে বদলি করা হয়।

আলিফ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছেন চট্টগ্রামের আইনজীবীরা। কর্মবিরতির কারণে ৭৪টি আদালতে বিচারিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়নি। আদালতপাড়ায় খুনিদের বিচার চেয়ে মিছিল ও মানববন্ধন করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামসহ কয়েকটি সংগঠন। তারা আসামিদের পক্ষে না দাঁড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন। ইসকন নিষিদ্ধ করতে স্লোগান দেন আইনজীবীরা। 

ওই দিনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। একই দাবিতে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ঘিরে আদালত প্রাঙ্গণের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। গতকাল দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেছেন, পুলিশের প্ররোচনায় সেদিন হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সব কর্মকাণ্ড আদালত ভবনে সংঘটিত হয়েছে।

নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে যখন কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো, তখন পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয় ছিল। কাদের ইন্ধনে চিন্ময় কৃষ্ণকে তিন ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তাঁকে হ্যান্ডমাইক দেওয়া হয়েছিল কেন। প্রিজন ভ্যান থেকে তিনি কীভাবে বক্তৃতা দিলেন। এসব বিষয়ে তদন্ত করার জন্য পুলিশ কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ তিনি বলেন, কারাগারে চিন্ময় দাসকে দেওয়া ডিভিশন প্রত্যাহার করতে হবে। নইলে কারাগার ঘেরাও করা হবে।

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ ছিল আদালতের কার্যক্রম। আগের দিনের মতো গতকালও চট্টগ্রামের ৭৪টি আদালতে কোনো শুনানি হয়নি। সকালে জেলা আইনজীবী সমিতির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। কালো ব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ জানান আইনজীবীরা।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) এ এন এম হুমায়ুন কবির বলেন, চট্টগ্রাম আদালতের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কোনো মামলার শুনানি হচ্ছে না। মামলাগুলো পরবর্তী তারিখে রাখা হচ্ছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *