■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
দেশে ফিরেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া আরও ২৬ বাংলাদেশি। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুর ৩টায় ভারতের ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের বিমানযোগে আরব আমিরাত থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন তারা। এ নিয়ে দুই দফায় আমিরাত থেকে ৪২ জন দেশে ফিরলেন।
তাদের দেশে ফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের ডেপুটি ডিরেক্টর মো. শরিফুল ইসলাম।
গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার গণহত্যা শুরু করলে বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করে দণ্ডিত হয়েছিলেন ৫৭ বাংলাদেশি। শেখ হাসিনার পতনের পর সে সব প্রবাসীদের দেশে আনার কাজ শুরু করেন অন্তর্বর্তী সরকার। পরে তাদের ক্ষমা করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
তাদের মধ্যে প্রথম ধাপে ১৪ বাংলাদেশি গত ৭ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেছেন। আজ দ্বিতীয় ধাপে আরও ২৮ বাংলাদেশি আরব আমিরাত থেকে দেশে ফিরেছেন। এ নিয়ে দুই দফায় আমিরাত থেকে ৪২ জন দেশে ফিরলেন।
গত ৩ সেপ্টেম্বর দণ্ডিত ৫৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশিকে ক্ষমা করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
এর আগে গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছিলেন, গত ২৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের। সেখানে বড় অংশজুড়ে ছিল ৫৭ জনের শাস্তি মওকুফের বিষয়টি। প্রধান উপদেষ্টা প্রেসিডেন্টকে প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট তার কথা রেখেছেন। প্রধান উপদেষ্টা এ সুখবরটি পেয়েছেন।
তিনি বলেন, তাদের ক্ষমা করানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এখন তাদের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের দূতাবাসের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, ওই দেশে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাদের বিষয়ে কী হবে, তা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সম্ভবত তারা দেশে ফিরে আসবেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদমাধ্যম গালফ নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির প্রেসিডেন্টের নির্দেশের সঙ্গে সংগতি রেখে অ্যাটর্নি জেনারেল চ্যান্সেলর ড. হামাদ আল শামসি সাজা বাস্তবায়ন বন্ধ করার ও নির্বাসন প্রক্রিয়া শুরুর আদেশ জারি করেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল সংযুক্ত আরব আমিরাতের সব বাসিন্দাকে দেশের আইনকে সম্মান করার জন্য আহ্বান জানিয়ে জোর দিয়ে বলেছেন, মতামত প্রকাশের অধিকার রাষ্ট্র ও এর আইনি কাঠামো দ্বারা সুরক্ষিত।
‘ইউনূস স্যার না থাকলে এত কম সময়ে মুক্তি পেতাম না‘
‘কারাগারে যাওয়ার পর স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের চিন্তায় ঘুম আসতো না। বিদেশের কারাগার জীবনের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি এখনও তাড়া করছে আমায়। ভাবতাম আইনি প্রক্রিয়ায় কে, কখন বের করবে। কখন পরিবারের কাছে দেশে ফিরব। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ইউনূস স্যারের (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) প্রচেষ্টায় আমরা জেল থেকে মুক্ত হয়ে বর্তমানে দেশে আছি। ইউনূস স্যার না থাকলে এত কম সময়ে মুক্তি পেতাম না। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা জানা নেই।’
শুক্রবার সকালে সাংবাদিকদের কথাগুলো বলছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে আসা ফরিদ আহমদ শাহিন। তিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চৌদ্দগ্রাম পৌর সদরের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আলী আহমেদের ছেলে। গত ৭ সেপ্টেম্বর আমিরাতে দণ্ডিত হওয়ার পর ক্ষমাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির মধ্যে ১৪ জন দেশে ফিরেছেন। তাদের একজন শাহিন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাহীন বলেন, গত ২০ বছর ধরে আরব আমিরাতের আইন মেনে বেশ সুনামের সঙ্গে দুবাই শহরে ব্যবসা করেছি। বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে গত ১৮ জুলাই দুবাইতে থাকা প্রবাসীরা স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে। আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম স্বৈরাচার হাসিনা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বুকে আর একটাও যেন গুলি না চালায়। আমরা জানতাম প্রতিবাদ করলে রাজতন্ত্র আইনে আমাদের শাস্তি হবে। সেই শাস্তির শঙ্কা উপেক্ষা করেই আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম।
তিনি বলেন, পরদিন ওই দেশের পুলিশ আন্দোলনরত বাংলাদেশিদের গ্রেফতার করে। পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। আমরা খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর কোনো উপায় দেখছিলাম না। সারাক্ষণ পরিবারের দুশ্চিন্তায় সময় কেটেছে। কারাগারে অবিরত চোখের পানি ফেলেছি।
শাহিন আরও বলেন, ৪৫ দিন আমার কাছে কয়েকশ’ বছরের মতো লেগেছিল। সময় যেন ফুরাচ্ছিল না। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের মুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের সরকার আমিরাতের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বিশ্বাস করুন- সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পড়ে গেছি। তার কয়েকদিন পর শুনলাম আমিরাতের রাষ্ট্রপতি আমাদের সাধারণ ক্ষমা করে মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। জীবনে বড় আনন্দের খবর আমার কাছে সেটিই ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, ৫৭ জনকে সাজা দেওয়ার খবর প্রকাশিত হলেও সাজাপ্রাপ্তদের প্রকৃত সংখ্যা ১১৪। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ- বাকি যে ৫৭ জন বাঙালি বন্দি আছেন, তাদের মুক্ত জন্য যেন উদ্যোগ নেওয়া হয়।