■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর গত আট বছরে ২ হাজার ৬০৬ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। এ সময়ে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন ১৪ হাজার ৬৮৫ জন।
২০১৭ সালে ১১৯ জন, ২০১৮ সালে ৩৬৫ জন, ২০১৯ সালে ৩৫৬ জন, ২০২০ সালে ৩২৩ জন, ২০২১ সালে ১৬৫ জন, ২০২২ সালে ৪২১ জন, ২০২৩ সালে ৫৪৮ জন এবং ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০৯ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দেশ জার্মানির নাগরিকত্ব নেওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এর পরে আছে জার্মানিরই প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া।
গত আট বছরে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ৪০টির বেশি দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশিরা। গত আট বছরে ১ হাজার ২৮১ জন বাংলাদেশি জার্মানির, ৩৯২ জন অস্ট্রিয়ার, ১৮০ জন সিঙ্গাপুর, ১৫১ জন ভারত, ৬০ জন কোরিয়া, ৫৭ জন নরওয়ে, ২৫ জন যুক্তরাজ্য, ১৭ জন ইউক্রেন, ১৫ জন শ্রীলঙ্কা, ১৩ জন করে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরান; ১১ জন ইন্দোনেশিয়া ও ৯ জন বুলগেরিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া পাকিস্তান ও মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়েছেন ৪ জন।
১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশিদের দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন শুরু করে সরকার। এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৮৭৫ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। ১৯৮৮ সালে ২২৭ জনকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগের তথ্যে ক্রমেই দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার তথ্য বাড়তে দেখা যায়। কয়েক বছরের ব্যবধান দিয়ে উপাত্তের দিকে তাকালে পাওয়া যায়: ১৯৮৯ সালে ৩১৫ জন, ২০০০ সালে ২৮৬ জন, ২০০৮ সালে ১ হাজার ১৮০ জন, ২০১৪ সালে ১ হাজার ৬৯৯ জন, ২০২০ সালে ১ হাজার ১৮৭ জন, ২০২২ সালে ১ হাজার ৭৮৬ জন এবং ২০২৩ সালে ৪ হাজার ১৩৩ জন বাংলাদেশি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশিদের নতুন করে আরও ৪৪টি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ করে দেয় মন্ত্রিসভা। এর আগে ৫৭টি দেশের নাগরিকেরা এ সুযোগ পেতেন। কয়েকটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কর্ণধাররা নিজে কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বা দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী বলে মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে।
কোনো কোনো দেশের পাসপোর্ট পাওয়ার শর্ত হিসেবে আগের দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। আবার কোনো কোনো দেশের পাসপোর্ট পাওয়ার পর নাগরিক হিসেবে শপথ নিতে হলে আগের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। এ জন্য উল্লিখিত বাংলাদেশিরা নাগরিকত্ব ছেড়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, কোনো বাংলাদেশি অন্য দেশের পাসপোর্ট (অর্থাৎ নাগরিকত্ব) গ্রহণের পর বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখতে না চাইলেও এ দেশে ৭৫ হাজার ডলার স্থায়ী বিনিয়োগ করে সহজেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান। সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করলেও তার পরবর্তী তিন প্রজন্মের বংশধরের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে বহাল থাকবে।
১৯৮৮ সালে প্রথম ৪ জন বিদেশিকে নাগরিকত্ব দেয় বাংলাদেশ। ১৯৮৯ সালে নাগরিকত্ব পান ৩৩ বিদেশি। এরপর ২০০৩ ও ২০১০ সাল ছাড়া প্রতিবছরই কিছু না কিছু বিদেশিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৪৫২ জন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই নাগরিকত্ব পেয়েছেন বৈবাহিক সূত্রে। দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের কারণেও বেশ কয়েকজনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে।
সার্বিকভাবে দেশে সুশাসনের অভাব থাকাতেই সুযোগ পেলে অনেকে দেশ ছাড়ছেন বলে মনে করেন শীর্ষ বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের যত গল্পই বলি না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সুযোগ পেলেই লোকজন দেশ ছেড়ে যেতে চান। এর একটা বড় কারণ হলো, সুশাসনের ঘাটতি। যখন কেউ দেখে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ক্রসফায়ার-গুম হচ্ছে, এসব কারণে নিজের বা সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তা করে তাঁরা দেশ ছাড়ছেন। রাজনীতিবিদ বা আমলারা যতই দেশের উন্নয়নের কথা বলেন না কেন, তাঁদের অনেকেই মনে করেন, দেশের আসলে ভবিষ্যৎ নেই। এ জন্য নিজের সন্তানদের বিদেশে পাঠান, নিজের বাড়ি-গাড়ি বিদেশেই করেন।’