তিন কলেজের সংঘাতে আহত ৩৫, বিজিবি মোতায়েন

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■ 

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ ও সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। 

সংঘর্ষের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

সোমবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকায় ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

সংঘর্ষে আহত বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মাথায় এবং নাকে-মুখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া এক শিক্ষার্থীর পেটে গুলি লেগেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।

আহতরা হলেন রাজীব, অনুপম দাস, শাহেদুল, হুমায়ুন, মো. রানা, সুমন, মো. মারুফ, মো. রুমান, মো. হাসিনুর রহমান, আরাফাত, মো. সিফাত, মো. আশিকুল, মো. নাফি, মো. জুয়েল ইসলাম, মো. নোমান, মো. তাসরিফ, মো. সাইদুল ইসলাম, মো. জাহেদুল, মো. আসিফ মাহমুদ, অনয়, মো. মারুফ, মো. মাহিম হোসেন, রাজীব, আব্দুর রহমান, মো. সাকির, মো. জুবায়ের রহমান সাজ্জাদ, ইনতিয়াক, মো. রোহান, সৈকত, সম্রাট, ইয়াসিন আরাফাত, মো. জারিফ, মো. নাঈম, জয়।

একই সংঘর্ষে আহত হয়ে ৩০ শিক্ষার্থী ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন।

আহতদের মধ্যে কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। তারা হলেন, নাইম, সিয়াম, মোল্লা সোহাগ, রাজিম, শরিফুল, জাহিদ, মোস্তফা, রাতুল, শফিকুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, সজিব বেপারী, ফয়সাল, সাগর, ইমন এবং সিয়াম।

হাসাপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ড. মাহমুদ বলেন, এখন পর্যন্ত ৩০ জন এসেছেন আমাদের কাছে। এর মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেফার করেছি। তাদের সেখানে ভর্তি হতে হবে।

যা বলছে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ কর্তৃপক্ষ

ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা-ভাঙচুর ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই হামলা, লুটপাটের ন্যায়বিচারের দাবিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে তারা।

সোমবার বিকেল ৫টার দিকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ অধ্যক্ষের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।  

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ গভীর শোক ও ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, আজ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক নৃশংস হামলা চালানো হয়েছে। সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য কলেজের ছাত্র, বহিরাগত একদল সন্ত্রাসী প্রবেশ করে কলেজ ভবনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, এ হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’

এতে বলা হয়, ‘হামলাকারীদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী নয় বরং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ।’

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘হামলাকারীরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, সম্পদ ও শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট, ব্যক্তিগত মালামাল লুট করেছে। এ ছাড়া কলেজ ভবনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে তারা অধ্যক্ষের কার্যালয়সহ বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর করে। এতে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি একই ভবনে অবস্থিত ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।’

‘কলেজ কর্তৃপক্ষ বার বার প্রশাসনের স্থানীয় ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে সহযোগিতার আবেদন করলেও, এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।’, বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে 

এছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে তিনটি দাবি তুলে ধরে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ কর্তৃপক্ষ। দাবিগুলো হলো-

১. হামলার প্রকৃত দোষীদের দ্রুত শনাক্ত ও গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান।

২. শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে কলেজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার।

৩. লুটকৃত সম্পদ উদ্ধার ও ক্ষতিগ্রস্ত নথি পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

এর আগে সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ গভীর শোক ও ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, আজ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক নৃশংস হামলা চালানো হয়েছে। তথাকথিত সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বহিরাগত একদল সন্ত্রাসী প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ হামলায় তিনজন শিক্ষার্থী নির্মমভাবে প্রাণ হারায় এবং শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’

শিক্ষার্থী নিহতের খবর সঠিক নয়

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ এবং ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হওয়ার খবর সঠিক নয় বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তাই ডিএমপির পক্ষ থেকে সবাইকে অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সংস্থাটি জানায়, ওই তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে প্রায় ২৫ জন আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লেখিত ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন বলে অনেকেই অপপ্রচার চালাচ্ছেন, যা সঠিক নয়।

সোমবার (২৫ নভেম্বর) বিকালে ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

ডিএমপি জানিয়েছে, ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার -এর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দুটি  ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষে ৩৫ কলেজের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি), আর অপর পক্ষে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের জোট। শিক্ষার্থী অভিজিৎ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও এ মৃত্যুকে ঘিরে কয়েকদিন ধরেই ওই দুই গ্রুপ পরস্পর বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। কয়েকদিন ধরে তাদের মধ্যে ঘটছে সংঘর্ষ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাও।

ডিএমপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ১৬ নভেম্বব ডেমরার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৮ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়। ওই দিন রাতে তার পরিবার ও কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে অভিযোগে হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়। ২০ নভেম্বর পুনরায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ৫০০-৬০০ শিক্ষার্থী ওই হাসপাতালে ভাঙচুর করে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় প্রতিবাদকারীদের চাপে হাসপাতালের পরিচালক চার জন ডাক্তার এবং দুই জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে অভিজিতের চিকিৎসা সংক্রান্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে হাসপাতাল চত্বরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যার পর স্থানীয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে আসে। এ সময় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা তা না মানায় উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের দুই ছাত্র আহত হন। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

এতে আরও বলা হয়, রোববার (২৪ নভেম্বর) আনুমানিক ২টার দিকে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পুনরায় ভাঙচুর চালায় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে তারা শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে ভাঙচুর এবং লুটপাট চালায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোমবার (২৫ নভেম্বর) শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের প্রায় ১২-১৫ হাজার শিক্ষার্থী শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও বাহাদুর শাহ পার্কে জমায়েত হয়। তারা আনুমানিক সকাল ১১টার দিকে ডেমরার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। আগে থেকে পুলিশ ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে অবস্থান করে। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা প্রতিহত করে লাঠিসোঁটাসহ ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দিকে অগ্রসর হলে যাত্রাবাড়ী মোড়ে পুলিশ পুনরায় বাধা দেয়। তারা বাধা অতিক্রম করে ওই কলেজে পৌঁছে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।

ডিএমপি জানায়, ৩৫টি বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি) নামে একটি ফোরাম গঠিত হয়। অপরপক্ষে রাজধানীর ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ ও সরকারি কবি নজরুল কলেজ মিলে সাত কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি জোট রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ৩৫ কলেজের ফোরাম ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও পরস্পরের প্রতি ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি হয়।

ডিএমপি আরও জানায়, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকাল ৭টা থেকে রাজধানীর সূত্রাপুর ও ডেমরা এলাকায় পর্যাপ্ত জনবল মোতায়েন করা হয়। মোতায়েন করা পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা অতিক্রম করে ড. মাহবুবুর রহমান  মোল্লা কলেজের দিকে অগ্রসর হয়ে ওই কলেজে হামলা চালায়। পুলিশ যেকোনও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য অতিরিক্ত বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে। পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তা সত্ত্বেও উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হামলায় জড়িয়ে পড়ে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *