বিএমইউর চিকিৎসকসহ ৩৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিচ্যুত

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ৩৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বছরের ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংস হামলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।

চাকরিচ্যুতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বেশ কয়েকজন নেতাসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা রয়েছেন। এসব শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চার ধরনের অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে কেবিন ব্লকের সামনে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ১৫ জন, ছাত্র-জনতার সঙ্গে মারামারিতে জড়িত ছিলেন প্রায় শতাধিক শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। নেপথ্যে থেকে ওই ঘটনার নেতৃত্বদান ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন ২৩ জন।

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) এলাকায় দুপুরে কেবিন ব্লকের সামনে একদল চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে চড়াও হন আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর। উপস্থিত সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে ভয়ংকর সব দৃশ্য। সেখানে দেখা যায়, এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ৩০টিরও বেশি গাড়ি-অ্যাম্বুলেন্স জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাঙচুর থেকে রক্ষা পায়নি প্রশাসনিক ভবন ও অফিস কক্ষ। এমনকি মূল্যবান যন্ত্রপাতি লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরে জানায়, সেদিনকার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সুস্পষ্ট ভিডিও প্রমাণ; ক্যাম্পাসে অগ্নিসংযোগ, মারামারি, ভাঙচুর ও লুটপাটে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

ওই ঘটনার ঠিক পরের সপ্তাহে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন যুক্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুলে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হত্যাচেষ্টা, মারধর ও ভাঙচুরের ঘটনায় গঠিত ১৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি টানা ৩৬টি সভা করে চূড়ান্তভাবে ৩৪ জন চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ’ এর ৮ (ক) (২) ধারা অনুযায়ী গঠিত কমিটির সভাপতি ছিলেন উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. কুদরত-এ-খুদা তালুকদার। তার সঙ্গে ছিলেন মেডিসিন, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, অ্যানাটমি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা। ছিলেন ফ্যাকাল্টি অব মেডিকেল টেকনোলজি ও ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অনুষদের ডিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের উপাচার্য প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং নাগরিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা সহায়তা ও শৃঙ্খলা কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্যরা।

কমিটির সদস্যরা ওই সময়ের ভিডিও ফুটেজ, নিরাপত্তা প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ, প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের জবানবন্দি এবং অভিযুক্তদের লিখিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তদন্তে দেখা গেছে, অভিযুক্তদের একাংশ সরাসরি হামলায় অংশ নেয়, কেউ-বা নেপথ্যে থেকে নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা দেয়, আবার কেউ নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধ্বংসে ভূমিকা রাখে।

এমনকি তদন্তের ভিত্তিতে কমিটি দুই দফায় শিক্ষার্থী হত্যাচেষ্টা, হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৩৪ জন শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ‘চূড়ান্তভাবে অপরাধ প্রমাণিত’ হয়েছে বলে সুপারিশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ও দক্ষতা অধ্যাদেশ অনুযায়ী, তাদের প্রত্যেককে চাকরি থেকে ‘পদচ্যুত’ বা ‘চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত’ করার প্রস্তাব করে কমিটি।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক শিক্ষার্থীকে ‘প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে’ যেভাবে নির্যাতন করা হয়, তার ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষ্য সুস্পষ্ট। ওই ঘটনায় ‘ক’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত ১৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা সরাসরি অংশ নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের ৫ (ঘ), ৫ (ঝ) এবং ৫ (ট) ধারায় আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়, তাদের চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে পদচ্যুত করার সুপারিশ করেছে কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় সংখ্যক চিকিৎসক-কর্মকর্তার একযোগে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ।

এছাড়া ‘খ’ ক্যাটাগরিতে থাকা ২৩ জনের মধ্যে ১৯ জনের বিরুদ্ধে সরাসরি ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, ভাঙচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগে অংশ নেওয়ার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিটিভি রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই ব্যক্তিরা হামলার সময় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাদের ক্ষেত্রেও অধ্যাদেশের ৬ (ঠ) ধারা অনুযায়ী চাকরি থেকে পদচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী, তাদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসক ও প্রশাসনিক পদে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী গত শনিবার (৩১ মে) অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে ‘ক’ ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টায় সরাসরি জড়িতদের এবং ‘খ’ ক্যাটাগরিতে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

‘ক’ ক্যাটাগরিতে অভিযুক্ত ১৫ জন হলেন- প্যালিয়েটিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আবু তোরাব মীম, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ রিয়াদ সিদ্দিকী, পরিচালক (হাসপাতাল) অফিসের পেইন্টার নিতীশ রায় ও মো. সাইফুল ইসলাম, এমএলএসএস মেহেদী কাজী, সহকারী ড্রেসার মো. শহিদুল ইসলাম, সুইপার সন্দীপ দাস, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী উজ্জ্বল মোল্ল্যা, পরিবহন শাখার ড্রাইভার সুজন বিশ্ব শর্মা, ওপিডি-১ এর এমএলএসএস ফকরুল ইসলাম জনি, ল্যাবরেটরি সার্ভিস সেন্টারের কাস্টমার কেয়ার অ্যাটেনডেন্ট রুবেল রানা, ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস শাহাদাত, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স শবনম নূরানী, ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস মো. আনোয়ার হোসেন এবং কার্ডিওলজি বিভাগের এমএলএসএস মো. মুন্না আহমেদ।

‘খ’ ক্যাটাগরিতে অভিযুক্ত ১৯ জন হলেন- ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারুক হোসেন, নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আহসান হাবিব, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লাহ, নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুভাষ কান্তি দে, অনকোলজি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোহাম্মদ জাহান শামস্, সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নূর-ই-এলাহী, অটোল্যারিংগোলজি- নাক কান গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসানুল হক, শিশু নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে এম তারিকুল ইসলাম, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশীষ কুমার সরকার, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল-মামুন, নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শাহনেওয়াজ বারী, কার্ডিওলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. অমল কুমার ঘোষ, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ।

এছাড়া এ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, জেনারেল সার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মাঈদুল হাসান, অর্থোপেডিক্স সার্জারি বিভাগের গবেষণা সহকারী/স্ব-বেতনে কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ তারিকুল মতিন, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেশিয়াল সার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. ওমর ফারুক এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ কুতুবউদ্দিন।

তদন্ত প্রতিবেদনে ‘খ’ ক্যাটাগরি তালিকায় ২৩ জনের নাম আসলেও তাদের মধ্য থেকে চারজনের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে পরবর্তীতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। তারা হলেন- অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. জিল্লুর রহমান ভূইয়া, নিউরোসার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মনোয়ার হোসেন, সহকারী পরিচালক ও উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. বেলাল হোসেন সরকার এবং প্রন্থোডনটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবিদ।

তদন্ত কমিটি আরও বলেছে, অভিযুক্তরা শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালাই লঙ্ঘন করেননি বরং ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন। অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, শারীরিক নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির আওতাভুক্ত গুরুতর অপরাধ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের এবং তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট তাদের প্রোফাইল, প্রমাণ ও তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করার সুপারিশ করেছে কমিটি।

তদন্ত প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম প্রথমে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বলেন, ‘এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না।’ বিষয়টি নিয়ে বারবার অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি স্বচ্ছভাবে কাজ করেছে, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা ব্যক্তিগত বিবেচনা এখানে কাজ করেনি। আমরা তদন্ত কমিটির সুপারিশ সিন্ডিকেটে আলোচনা করেছি এবং সেখানকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রশাসনিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছি।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *