নুরাল পাগলার দরবারে হামলা, মামলার আসামি ৩৫০০

রাজবাড়ী প্রতিনিধি ■

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক মোল্লা ওরফে নুরাল পাগলার দরবারে হামলার সময় পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ৩ হাজার ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।  গোয়ালন্দ ঘাট থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে এই মামলাটি দায়ের করেন।

শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকালে গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রাকিবুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, গতকালের (শুক্রবার) ঘটনায় ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এ আসামিদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।

জানা গেছে, শুক্রবার (৫ আগস্ট) জুমার নামাজের পর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নুরাল পাগলার দরবারে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় নুরাল পাগলের ভক্তদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং দুই পক্ষের শতাধিক মানুষ আহত হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয় ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এতে ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে নুরাল পাগলের মরদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেন হামলাকারীরা।

গতকালের ঘটনার পর আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। দরবারের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তবে ধ্বংসস্তূপ দেখতে ভিড় করছেন উৎসুক জনতা।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, একসময় নিজেকে ইমাম মাহাদি বলে দাবি করেছিলেন নুরুল হক। গত ২৩ আগস্ট মারা যান তিনি। এরপর তার ভক্তরা দরবারের ভেতরে তাকে কবর দেন এবং কবরের উপরের ১০-১২ উঁচু একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়, যা সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থিত মুসলমানদের কেবলা কাবা শরীফের মতো দেখতে। তাই এ নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছিলেন স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।

এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। পরে শুক্রবার জুমার নামাজের পর তৌহিদি জনতার ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন মুসল্লিরা। পরে তারা দরবারে হামলা চালান এবং দরবারের ভেতরে থাকা নুরাল পাগলার কবর ভেঙে দেন। সেই সঙ্গে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে তা পুড়িয়েও দেন তৌহিদি জনতা।

রাজবাড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. শরীফ আল রাজীব বলেন, গতকাল বিক্ষুব্ধ জনতা গোয়ালন্দের নুরাল পাগলার দরবার শরীফে হামলা চালায়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে তখন পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় আমাদের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গোয়ালন্দঘাট থানায় মামলা দায়ের করেছে। আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।

সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড জুড়ান মোল্লা পাড়ায় অবস্থিত নুরাল পাগলার দরবারের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ আছে। উৎসুক জনতা ভিড় করছে। দরবারের ভেতর একটি তিনতলা এবং একটি দুইতলা ভবন।

তিনতলা ভবনে পরিবারসহ নুরাল পাগলা থাকতেন। দুটি ভবনের সব কটি কক্ষ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আসবাবপত্র সব খোয়া গেছে। অবশিষ্ট জিনিসপত্র ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভবন থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে নুরাল পাগলার আস্তানা। সেখানে একটি টিনশেড ঘরে বসে ভক্তদের সঙ্গে সময় কাটাতেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর আগে টিনশেড ঘরসহ সমতল ভূমি থেকে কয়েক ফুট উঁচু করে বেদি তৈরি করা হয়। বেদির ওপর একপাশে টিনশেড ঘরে তিনি বসে সময় কাটাতেন। অপর পাশে মৃত্যুর পর তাঁকে কবর দেওয়া হয়। দরবারের ভেতর এখন ধ্বংসস্তূপ। ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। কেউ কেউ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ থেকে চাল–ডালসহ জিনিসপত্র কুড়িয়ে নিচ্ছেন। পুলিশ মাঝেমধ্যে উৎসুক জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছে।

কুষ্টিয়ার পোড়াদাহ থেকে এসেছেন আবুল হোসেন (৬০) নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার দেশের আলোচিত খবর ছিল নুরাল পাগলার দরবারে হামলা। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে খবরটি দেখে আর থাকতে পারলাম না। কী হয়েছে দেখতে রাতে গোয়ালন্দে এক আত্মীয়ের বাড়ি আসি। আজ সকালে দরবারে এসে দেখে গেলাম। তাঁর কাজ বিতর্কিত ছিল, তাই বলে লাশ কবর থেকে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি।’

রাজবাড়ীর পাংশা থেকে আসা রত্না বিশ্বাস বলেন, ‘তিনি অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন বলে তাঁকে আমরা প্রণাম করতাম। দরবারে হামলার কথা শুনে দেখতে এসেছি।’

এ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি ও নুরাল পাগলার পরিবারের কয়েক দফা বৈঠক হয়। তবে কবর নিচু না করায় দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয় ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। তারা সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতল করাসহ বিভিন্ন দাবি জানায়। অন্যথায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, বেলা তিনটার দিকে মঞ্চ থেকে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, সদস্যসচিব বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী খান সবাইকে সমাবেশে থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু উত্তেজিত লোকজন মিছিল নিয়ে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা করেন। ভেতর থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন নুরাল পাগলার ভক্তরা। এ সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন।

নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবারের ভেতর হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। আগুন ধরিয়ে সব পুড়িয়ে দেয়ছবি: প্রথম আলো

এ সময় কিছু লোক দরবারের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেন এবং মালামাল লুটপাট করেন। একপর্যায়ে বিকেল পাঁচটার দিকে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে গোয়ালন্দ পদ্মার মোড়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ওপর নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

সংঘর্ষে আহত রাসেল মোল্লা নামের নুরাল পাগলার এক ভক্ত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তিনি গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম তেনাপচা গ্রামের আজাদ মোল্লার ছেলে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *