■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে ৩৯০ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় এবং ২৯ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণের পর ১৫ শিশু খুন হয়েছে ও ৫ জন আত্মহত্যা করেছে।
কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণবিষয়ক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছে এডুকো বাংলাদেশ। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন তুলে ধরেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর সৈয়দা আহসানা জামান।
এতে বলা হয়, চলতি বছরের আট মাসে ৩৪ জন শিশু অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জন কন্যা শিশুকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই সময়ে ৮৩ জন কন্যাশিশু খুন হয়েছে এবং ৫০ জন কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে, যাদের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি।
২০২৪ সালের প্রথম ৮ মাসে মোট ২২৪ জন এবং ২০২৩ সালে ৪৯৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া গত ৮ মাসে ১৩৪ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। আর গত বছর একই সময়ে ৩২ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বরাতে প্রতিবেদনে ৮৪টি আলোচিত ধর্ষণ মামলার ভিকটিম ও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত বাদী, বিবাদীদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক তথ্য তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল এই সময়ে সংঘটিত ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তদের ২০ দশমিক ২৩ শতাংশ মাদকাসক্ত, ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। আর ভুক্তভোগীদের ৭২ দশমিক ৬১ শতাংশ শিশু ও ছাত্রী। অনেক ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ভুক্তভোগীর আত্মীয় ও পরিচিত। এ ছাড়া অধিকাংশ ভুক্তভোগী অতিদরিদ্র পরিবারের।
এ ছাড়া গত ৮ মাসে অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ৩৪ কন্যাশিশু। এর মধ্যে অপহরণের শিকার ১৮ শিশুকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্টে ১০৪ কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। একই সময়ের মধ্যে ৮৩ শিশু খুন হয়েছে। খুনের হিসাব গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ১৫ জন, যৌতুকের জন্য ৪ জন, অন্যান্য কারণে পারিবারিক নির্যাতনে ৩১ জন, পূর্বশত্রুতার কারণে ৯ জন ও প্রেমের সম্পর্কের কারণে ৫ জন খুন হয়েছে। এ ছাড়া ১৯ শিশুর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।
আইন কার্যকর না থাকায় দেশে বাল্যবিবাহ এবং নারীর প্রতি সাইবার বুলিং বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া জানুয়ারি থেকে আগস্টের এই সময়ে মোট ৫৪ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তবে ২০২৩ সালের তুলনায় কম। ২০২৪ সালের একই সময়ে ২৮ জন এবং ২০২৩ সালে ১১৭ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কন্যাশিশু ও নারীরা পথেঘাটে, যানবাহনে, বাজারে, জনবহুল স্থানে, এমনকি শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বাসাবাড়িতে হরহামেশা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন তুলে ধরেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেটর সৈয়দা আহসানা জামান এ্যানি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে অবশ্যই নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যাতে একজন নারী বা কন্যশিশু যেকোনো সময়ে কোনো ধরনের সহিংসতার ভয় ছাড়াই ঘর-বাসা থেকে বের হতে পারেন এবং নির্বিঘ্নে পথ চলতে পারেন। একইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারী ও কন্যাশিশুদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু এখনো তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমি মনে করি, বাল্যকাল থেকেই নারীদের প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার। বাল্যকাল থেকেই তাদের জন্য সুযোগ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার, তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করা দরকার। নারীর অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন হলে পুরো জাতির অবস্থা পরিবর্তিত হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনায় পাঁচবার উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়নি। এই ঘটনায় মূলত নারী রাজনৈতিক অধিকার পরাজিত হয়েছে। কেউ জয়ী হয়নি, পুরুষতন্ত্র জয়ী হয়েছে।’
সংকট থেকে উত্তরণে ১১টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্তকরণ ও নিপীড়ন রোধে সর্বস্তরের জন্য ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুমোদন; শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সব ঘটনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা; ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ এলে ধর্ষণের শিকার নারী ও কন্যার পরিবর্তে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে এ ঘটনা ঘটায়নি, এ–সম্পর্কিত প্রচলিত আইনের বিধান সংশোধন করা; হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠনের কঠোর নির্দেশনা মনিটরিংয়ের ভিত্তিতে নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি বদিউল আলম মজুমদারের সভাপতিত্বে এবং অপরাজেয় বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানুর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের পলিসি, অ্যাডভোকেসি, ইনফ্লুয়েঞ্জিং অ্যান্ড ক্যাম্পেইনের পরিচালক নিশাত সুলতানা, আইনজীবী ফাহমিদা রিংকী।