■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
পুরান ঢাকায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগ (৪৩) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুবদলের দুই নেতাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। হত্যার ঘটনায় পৃথক দুই মামলায় দুইজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে গ্রেফতার মাহমুদুল হাসান মহিনের ৫ দিন ও তারেক রহমান রবিনের ২ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
তারা হলেন- যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকি। তাদের বিরুদ্ধে সোহাগের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।
শুক্রবার রাতে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূইয়ার সই করা গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ৯ জুলাই রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের মূল ফটকে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ী যুবককে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষে থেকে মামলা করা হয়। আসামিরা হলেন- যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পদাক রজ্জব আলী পন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকি। তাদের প্রাথমিক সদস্য পদসহ দল থেকে আজীবন জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি আবদুল মোনায়েন মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম নয়ন ইতোমধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছেন।
এতে আরও বলা হয়েছে, বহিষ্কৃত নেতাদের কোনো ধরনের অপকর্মের দায়-দায়িত্ব দল নেবে না। যুবদলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের তাদের সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক না রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনোরূপ শৈথিল্য না দেখিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে যুবদল।
এদিকে এ ঘটনায় অভিযুক্তদের আজীবনের জন্য বিএনপি বহিষ্কার করেছে জানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেট সংলগ্ন রজনী ঘোষ লেনে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
নিহত মো. সোহাগ কেরানীগঞ্জ মডেল থানার পূর্ব নামাবাড়ি গ্রামের ইউসুফ আলী হাওলাদারের ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মিটফোর্ড এলাকার ৪ নম্বর রজনী ঘোষ লেনে ভাঙাড়ির ব্যবসা করতেন। ঘটনার পর পুলিশ মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে আটক করে। পরে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা ও একটি অস্ত্র মামলা দায়ের হয়।
গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি বলেন, বুধবার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে একদল লোক লাল চাঁদ সোহাগ নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহতের বড় বোন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে মামলার আসামি মাহমুদুল ও রবিনকে গ্রেফতার করে। এ সময় রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
ডিএমপি জানায়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও পূর্ব শত্রুতার জেরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে। ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে এবং অন্য জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানিয়েছে, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১০।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, র্যাব-১০ রাজধানী থেকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেফতার করেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো হবে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঘটনার সময় হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা চালু ছিল এবং আনসার ক্যাম্পের সদস্যরাও আশপাশে অবস্থান করছিলেন। তবে এমন ভয়াবহ সন্ত্রাসের সামনে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে সোহাগকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে চিকিৎসক জানান, তিনি ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোহাগের মৃত্যুর পরও হামলাকারীরা থামেনি। তার রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাস্তার মাঝে ফেলে রেখে চলে নৃশংসতা। কেউ লাশের বুকের ওপর লাফায়, কেউ মুখে কিল-ঘুষি দেয়।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, এক হামলাকারী মোবাইলে কথা বলার সময় পাশ থেকে চলছিল লাশের ওপর মারধর।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, নিহত সোহাগ মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙাড়ি ও পুরোনো বৈদ্যুতিক কেবল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার দোকানের নাম ছিল ‘সোহানা মেটাল’। বিদ্যুতের তামার ও সাদা তারের ব্যবসার একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করতেন তিনি। এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিলেন মাহমুদুল হাসান মহিন ও সারোয়ার হোসেন টিটু। তারা নিয়মিত চাঁদা দাবি করছিলেন এবং ব্যবসার ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন। এই বিরোধ থেকেই হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিহত সোহাগ এবং হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া মহিন ও টিটুসহ অধিকাংশ আসামি ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের সংগঠনে কোনো আনুষ্ঠানিক পদ ছিল কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি।
এ ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় নাম উল্লেখ করে ১৯ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী ও আনিসুর রহমান হাওলাদার।
ব্যবসায়ীকে হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ
রাজধানীর পুরান ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনের সড়কে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯) নামের এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়। মিছিলটি ভিসি চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যের উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘পাথর মেরে সোহাগ খুন, বিএনপি জবাব দে’, ‘সন্ত্রাস রুখে দেবে ছাত্রসমাজ’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘যেভাবে ছাত্রবন্ধুরা আজ প্রতিবাদে নেমেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও আমরা একইভাবে প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু বিএনপি এখন নিজেদের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ১৬ বছর যাঁরা মজলুম ছিলেন, তাঁরা এখন জালিমে পরিণত হয়েছেন।’
বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘এই চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের আমরা বিচার চাই। শুধু সোহাগ নয়, গত ১০ মাসে বিএনপির সন্ত্রাসে একশ’র বেশি মানুষ খুন হয়েছে। প্রতিটি হত্যার বিচার করতে হবে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি আরও বলেন, দেশে নির্বাচন হতে হলে আগে রাজনীতির সংস্কার হতে হবে। সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে আমরা দেশকে নতুন করে গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই পথে একমাত্র বাধা একটি সন্ত্রাসী দল। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জাতীয়তাবাদী চাঁদাবাজ দল একজন ব্যবসায়ীকে পাথর দিয়ে হত্যা করছে।’