ঋণের বোঝায় স্ত্রী-সন্তানদের হত্যার পর দিনমজুরের আত্মহত্যা

■ রাজশাহী প্রতিনিধি ■

রাজশাহীতে ঋণের বোঝা টানতে না পেরে অভাব অনটনে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেই আত্মহননের পথ বেছে নেন কৃষক দিনমজুর মিনারুল ইসলাম। শুক্রবার সকালে দুই ঘর থেকে একই পরিবারের চার জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃত্যুর আগে দুই পৃষ্ঠার সুইসাইড নোট রেখে যায়।

মৃত ব্যক্তিরা হলেন- ওই এলাকার বাসিন্দা মিনারুল ইসলাম (৩৫), স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮) এবং তাঁদের ছেলে মাহিন (১৩) ও মেয়ে মিথিলা (২)। মাহিন খড়খড়ি উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। আর মিনারুল কৃষিকাজ করতেন।

তাতে উল্লেখ রয়েছে, অভাব ও ঋণের কারণেই পুরো পরিবাকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। সুইসাইড নোটে তাদের এই মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। তবে কসম দিয়ে যায়, তার বড় ভাইয়ের পরিবার কেউ তাদের মরা মুখ যেন না দেখে এবং জানাজায় উপস্থিত না হয়। একই পরিবারের চার জনের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।  

পুলিশ মরদেহগুলো উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পুলিশের ধারণা, প্রথমে স্ত্রী ও মেয়েকে, পরে ছেলেকে শ্বাসরোধে হত্যা করে মিনারুল আত্মহত্যা করেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার হয়েছে, যেখানে অভাব ও ঋণের চাপকে এ হত্যাকাণ্ড ও আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বছর দুয়েক আগে জুয়া খেলে বিপুল ঋণে জড়িয়ে পড়েন মিনারুল। তিনি বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন, সপ্তাহে ২ হাজার ৭৪০ টাকা কিস্তি দিতে হতো। সেই হিসেবে মাসে ১০ হাজার ৯৬০ টাকা শোধ করতে হতো। কৃষিকাজ করে সেই টাকা শোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তার বাবা রুস্তম আলী জমি বিক্রি করে কিছু ঋণ পরিশোধ করলেও বাকি দেনা শোধ হয়নি। আর্থিক সংকটে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও তেমন সাহায্য পাননি মিনারুল, যা তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে।

মিনারুলের চাচি জানান, আগে থেকেই জুয়ার আসক্ত ছিলেন মিনারুল। প্রায় দেড় বছর আগে তার বাবা রুস্তম আলী দেড় লাখ টাকায় জমি বিক্রি করে আংশিক ঋণ শোধ করেন। তবে পুরো ঋণ শোধ না হওয়ায় বাবার প্রতি ক্ষোভ ছিল মিনারুলের। এ কারণে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন না, যদিও সন্তানদের দাদা-দাদির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল।

ঘটনার দিন সকালে রুস্তম আলী খড়খড়ি হাট থেকে মাছ কিনে এনে স্ত্রী আঞ্জুময়ারাকে বলেন মিথিলাকে ডাকতে। কিন্তু বারবার ডাকেও কোনো সাড়া মেলেনি। পরে পাশের ঘরে গিয়ে তারা দেখতে পান মিনারুল ঝুলছে। চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসে এবং পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার আবু সুফিয়ান বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে হত্যার পর মিনারুল আত্মহত্যা করেছে। মরদেহগুলো শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। একটি চিরকুট উদ্ধার হয়েছে যেখানে ঋণগ্রস্ততার কথা লেখা রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে, মামলা হবে।’

পুলিশ জানায়, প্রাথমিকভাবে অপমৃত্যুর মামলা হবে। তদন্তে আত্মহত্যায় প্ররোচনার প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনাটি পিবিআই, সিআইডি ও র‍্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করেছে।

আত্মহননকারী মিনারুলের পরিবার ও স্বজনরা জানায়, ছেলে হিসেবে সে খুবই ভালো, স্ত্রী সন্তানকে ভালোবাসতো। কোন দাম্পত্য কলহ ছিল না। কিন্তু ঋণে ডুবে থাকায় মানসিক অশান্তিতে ছিল। কিভাবে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না। 

সংবাদ পেয়ে মিনারুলের শাশুড়ী ও মনিরা বেগমের মা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। মেয়ে জামাই ও দুই নাতির মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন তার জামাই অনেক ভালো। মেয়ের সাথে ভালো আচরণ করতো। আগে জুয়া খেললেও বিয়ের পর সেগুলো ছেড়ে দেয়। কোন নেশা তার ছিল না। বড় নাতির হাতের চিকিৎসার জন্য মেয়ে তার বাড়ীতে ২০ দিন ছিল। গত ১৫দিন আগে দুই নাতিকে নিয়ে শশুরবাড়ী আসে। 

ঋণ সম্পর্কে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে মিনারুলের শাশুড়ী জানান, মেয়ের মুখে শুনেছেন দুটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিল তার স্বামী। প্রতি সপ্তাহে সেই ঋণের কিস্তির টাকা দিতে কষ্ট হতো। 

মৃত মিনারুলের পিতা রুস্তম আলী জানান, এর আগে তার ছেলের মোটা অংকের টাকা ঋণ ছিল। জমি বিক্রি করে সেই ঋণ শোধ করেন। নতুন করেন ঋণগ্রস্থ হওয়ার বিষয়টি তিনি জানতেন না। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *