■ শেরপুর প্রতিনিধি ■
টানা ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরে ভয়াবহ বন্যায় পানিতে ডুবে নারী, বৃদ্ধ ও কিশোরসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
মৃতরা হলেন- নালিতাবাড়ী উপজেলার অভয়পুর গ্রামের বাছির উদ্দিনের ছেলে হাতেম আলী (৩০) ও তার ভাই আলমগীর (১৬), উপজেলার বাঘবেড় বালুরচর গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী মিজা বেগম। একইদিন সন্ধ্যায় খলিসাকুড়া গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যান বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী। তবে মৃত আরেকজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ, কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, গবাদি পশু, বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েকটি মহাসড়কসহ অসংখ্য গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক। কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকা। সংকট তৈরি হয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির।
শুক্রবার দুপুরে উপজেলার অভয়পুর গ্রামের বাছির উদ্দিনের ছেলে হাতেম আলী ও সহোদর আলমগীর চেল্লাখালী নদীর ভেঙে যাওয়া পানির স্রোতে নিখোঁজ হন। পরে শনিবার পানি কিছুটা কমে আসায় বিকেল ৪টার দিকে কুতুবাকুড়া গ্রামের ধানক্ষেত থেকে ওই দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বন্যার পানিতে ডুবে মারা যান উপজেলার বাঘবেড় বালুরচর গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী মিজা বেগম। একইদিন সন্ধ্যায় খলিসাকুড়া গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যান বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী। এছাড়া আরও একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও এখনও পর্যন্ত তার নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছানোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা চারজনের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছি। বাকি একজনের পরিচয় জানা যায়নি।
বানভাসি মানুষকে উদ্ধারে শুক্রবার থেকেই কাজ করছে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিজিবি ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। শনিবার দিনভর স্পিডবোট, নৌকা, ভেলা, টিউব ইত্যাদি নিয়ে চলে বন্যায় আটকেপড়াদের উদ্ধার অভিযান। এছাড়াও শুকনা খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে বানভাসীদের মাঝে। এসব কাজে অংশ নিয়েছে উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভোগাই নদীর নাকুগাঁও পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার ও নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীর পানি কিছুটা কমলেও থেমে থেমে ভারি বর্ষণের ফলে তেমন উন্নতি হচ্ছে না। অন্যদিকে নদীর পানি ভাটি অঞ্চলে গিয়ে বন্যার তীব্রতা বাড়িয়েছে।
শনিবার রাত থেকে প্লবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালে, সিলিংয়ে ও মাচায়। নালিতাবাড়ী-শেরপুর মহাসড়কের রানীগাঁও এলাকায় মহাসড়কের বড় ধরনে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভেসে গেছে এসব এলাকার সব পুকুরের মাছ, কারও গবাদি পশু, নষ্ট হয়ে গেছে উঠতি আমনের খেত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাকিবুজ্জামান খান জানান, নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই এবং চেল্লাখালী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভোগাই, চেল্লাখালী এবং মহর্ষি নদীর বেশ কয়েকটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি রোধে জরুরি ভিত্তিতে কাজ চলছে।
এ বিষয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান শনিবার সকালে বলেন, পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধারের জন্য ঢাকা ও ময়মনসিংহ থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবীরা এবং উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও স্থানীয় স্বেচ্ছা সেবীরা কাজ করছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, নালিতাবাড়ী উপজেলায় এ বছর ২৩ হাজার ২০০ হেক্টর আমন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় আট হাজার হেক্টর আমন আবাদ তলিয়ে গেছে। কিছু এলাকায় পানি নেমে গেলেও নিচু এলাকায় নতুন করে বন্যার পানি ঢুকে আমন আবাদ তলিয়ে গেছে।
শেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার কর্মকার বলেন, আমরা তিনটি উপজেলার তথ্য সংগ্রহ করছি। সঠিক হিসাব আগামীকালকের মধ্যে দেওয়া হবে। তবে ঝিনাইগাতী সদর, নলকুড়া, গৌরিপুর এবং নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল, রামচন্দ্রকুড়া এবং নালিতাবাড়ী সদর ইউনিয়নের সব মৎস খামার তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, জেলার তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত মারা গেছেন চারজন। দুর্গতদের উদ্ধারে শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করছি। নতুন নতুন যেসব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আমরা তার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। পাশপাশি ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণেও কাজ করা হচ্ছে।
জেলা সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কের যেসব জায়গায় বেশি ভেঙে গেছে সেগুলো পানি নেমে যাওয়ার পর যতদ্রুত সম্ভব মেরামত শুরু করা হবে।’ জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, শেরপুরের বন্যাপরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনই জানা যাচ্ছে না।