শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংককে অকার্যকর ঘোষণা

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত শরিয়াভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করতে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে অকার্যকর ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাব এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সম্পদ থেকে দায় বেশি থাকায় একীভূত হওয়া পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার মূল্য শূন্য করা হয়েছে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না, কারণ প্রতিটি ব্যাংকের প্রতি ১০ টাকার মূল্যের শেয়ারের নিট সম্পদমূল্য সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা পর্যন্ত নেতিবাচক হয়ে গেছে। ফলে স্পন্সর ও সাধারণ উভয় শ্রেণির শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারের মূল্য শূন্য ধরা হয়েছে।

বুধবার (৫ নভেম্বর) বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই কথা জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে আর্থিকভাবে দুর্বল পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংককে অকার্যকর ঘোষণা করে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো: এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।

গভর্নর বলেন, ব্যাংকগুলোর বর্তমান আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পুঁজিঘাটতি ও অনিয়মের কারণে এগুলো টেকসইভাবে পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে এই ব্যাংকগুলো চালানো হবে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে না, গ্রাহকের অর্থ ও আমানত সুরক্ষিত থাকবে।

একীভূত হওয়া পাঁচ ব্যাংক এখন সরকারি উল্লেখ করে তিনি বলেন, একীভূত হলে প্রথমদিন থেকে বাজারভিত্তিক মুনাফা পাবেন গ্রাহকরা। এলসি ও রেমিট্যান্সের কার্যক্রম চলমান রাখবেন প্রশাসকরা। কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হবে না; তারা আগের মতোই বেতন-ভাতা পাবেন।

সরকার পরিবর্তন হলেও ভয় নেই জানিয়ে মনসুর বলেন, এটি সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাংক হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার স্বচ্ছতা আনতে বিশেষ অডিট শুরু করেছে। প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে একীভূতকরণ বা পুনর্গঠনের বিকল্প ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে।

এস আলমসহ যারা ব্যাংক খাত ধ্বংসে অপকর্ম করেছে তারা আর কখনো ফিরতে পারবে না।

পৃথক পৃথক চিঠিতে বলা হয়েছে, আজ ৫ নভেম্বর থেকে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম স্থগিত করা করেছে। এখন থেকে এসব ব্যাংক চলবে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আওতায়। প্রশাসক হিসেবে কোন ব্যাংকে কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং তাদের কাজ কী হবে, তা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রশাসকেরা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম ধাপে প্রত্যেক আমানতকারীকে আমানত সুরক্ষা তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, একীভূত করে একটি নতুন সরকারি মালিকানাধীন ইসলামি ব্যাংক গঠন করা হবে। যার নাম হবে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আজকে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বুধবার ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের জরুরি তলব করেছেন গভর্নর। জানা গেছে, বৈঠকে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোর কোম্পানি সচিবদের এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে সরকার সরবরাহ করবে ২০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার আমানতকারীদের দেওয়া হবে। একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলোর মোট ৭৫ লাখ আমানতকারীর জমা বর্তমানে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যেখানে ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৭৬ শতাংশ খেলাপি।

দেশজুড়ে এসব ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে। খেলাপি ঋণের হার ব্যাংকভিত্তিকভাবে যথাক্রমে: ইউনিয়ন ব্যাংক ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ৯৭ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামি ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামি ৬২.৩০ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংক ৪৮.২০ শতাংশ।

এর আগে গত ৯ অক্টোবর সরকারি মালিকানাধীন ইসলামি ব্যাংক গঠনের অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাব এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত  হয়।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, তারল্য সংকট, বিশাল অঙ্কের শ্রেণিকৃত ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি এবং মূলধন ঘাটতি— এসব কারণে ব্যাংকগুলো কার্যত দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছেছে। অনেকবার তারল্য সহায়তা দেওয়ার পরও এই ব্যাংকগুলোর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং তাদের শেয়ার মূল্য মারাত্মকভাবে পড়ে গেছে এবং প্রতিটি ব্যাংকের নিট সম্পদ মূল্য বা নেট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে।

 পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের মালিকানা আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের। বাকি চার ব্যাংকের মালিকানা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের ছিল। বিগত সরকারের মেয়াদে এসব ব্যাংক থেকে বিভিন্ন নামে-বেনামে অর্থ তুলে নেন মালিকরা। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকগুলো।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই পাঁচ ব্যাংকের নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নিয়েছে। এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটিতে স্বতন্ত্র পরিচালকদের দায়িত্ব দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *