■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পঞ্চম বার্ষিকী আজ। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরে বাংলা হলে তাকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
আবরার বুয়েটের ১৭তম ব্যাচের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন।
ভারতবিরোধী স্ট্যাটাস দেওয়ায় ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর মধ্যরাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রাত ৩টার দিকে হলের দ্বিতীয় তলা থেকে আবরারের লাশ উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষ।
সেই ২০১১ নম্বর কক্ষটিকে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতো ছাত্রলীগ। সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেই রুম থেকে নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্ট্যাম্প, রড, চাকু ও দড়ি উদ্ধার করেছিল ডিবি পুলিশ।
২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি ও গ্যাস চুক্তির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আবরার।
ওই দিনই শেরেবাংলা হলের গেস্টরুমে আসামিরা সভা করে আবরারকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
স্ট্যাটাসটি দেওয়ার সময় তিনি কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। পর দিন (৬ অক্টোবর) বিকালে তিনি বাড়ি থেকে বুয়েটের হলে ফেরেন।
হলে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মাথায় রাত ৮টার দিকে আবরারসহ দ্বিতীয় বর্ষের সাত-আটজন ছাত্রকে শেরেবাংলা হলের দোতলার ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতা।
তারা আবরার ফাহাদের মোবাইল নিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে দেখেন। এ সময় আবরার শিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ আনা হয়। আবরার এসব অস্বীকার করলে শুরু হয় স্টাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতাকর্মী আসেন। তারা আরেক দফা পেটান আবরারকে।
মার খেয়ে একপর্যায়ে আবরার অচেতন হয়ে পড়লে কোলে করে মুন্নার কক্ষে (২০০৫ নং) নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার আরও অবনতি হলে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মধ্যবর্তী জায়গায় অচেতন আবরারকে নিয়ে যান তারা। অচেতন আবরারের চিকিৎসার জন্য হল প্রভোস্ট ও চিকিৎসককে খবর দেয় ছাত্রলীগের সেসব কর্মী। কিন্তু এরই মধ্যে প্রাণ হারান আবরার।
চিকিৎসক এসে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন। তখন কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয়।
আবরার হত্যার ঘটনায় তার বাবা মো. বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা করেন।
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ২০ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। এছাড়া এ মামলার অপর পাঁচ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মুজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এ এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল), মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল), এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) এবং মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল)। এর মধ্যে শেষের তিনজন পলাতক রয়েছে।
যাবজ্জীবনের ৫ আসামি হলো- বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।
ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন মা
পাঁচ বছর ধরে আবরার ফাহাদের বিভিন্ন স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছে পরিবার।
সোমবার (৭ অক্টোবর) সকালে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের পাশে আবরারের বাড়িতে গেলে মা রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। বাড়িতে তিনি একাই ছিলেন। আবরারের একমাত্র ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বুয়েটে যন্ত্র কৌশলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বুয়েটে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকায় গেছেন।
কথা হলে অশ্রুসিক্ত চোখে আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে এই দিনে ছেলেকে সকালে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। বিকেলে বুয়েটে পৌঁছায়। এরপর তাঁকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ডেকে রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। তাঁরা ছাত্রলীগ করলেও তারই কয়েকজন বন্ধু ছিল। তাঁরাও একটি বারের জন্যও ফোনে জানায়নি ছেলে নিহত হওয়ার বিষয়ে।’
আবরারের মা শোকেস থেকে একটি ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল ফোন বের করে দুই হাতে নেড়েচেড়ে বলেন, ‘এগুলো ছেলের। যত্নে রেখেছি আজও।’ সেগুলো আবারও শোকেসের ভেতরে রাখলেন। তিনি আরও বলেন, ‘জানো, আজ যদি আমার ছেলে বেঁচে থাকত তাহলে চাকরি করত। আরও কত কী হতো।’ এভাবেই স্মৃতিচারণ করতে থাকেন মা রোকেয়া খাতুন।
রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘ছেলের আম্মু আম্মু ডাক এখনো কানে বাজে। ভুলতে পারি না। কীভাবে ভুলব? এই সন্তানকে ভোলার নয়। তাঁকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটা মনে হলেই শিউরে উঠি। তাঁর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকা।’
তিনতলার বাড়ির নিচতলাতে থাকে আবরারের পরিবার। একটি কক্ষে বেশ পরিপাটি করে সাজানো। খাটের একপাশে বড় একটি শোকেস। সেটির পাশে দাঁড়িয়ে রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘ছেলে বুয়েটে যে বিছানায় থাকত। সেখান থেকে সবকিছু জিনিসপত্র নেওয়া আসা হয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নেওয়া হয়েছে।’
শোকেসের ভেতর হাতঘড়ি থেকে শুরু করে ব্যাগ বইপত্র, প্রসাধনী, আইডিকার্ডসহ আরও অনেক কিছুই যত্নে রেখেছেন। জুতা, একটি গ্লোব, পোশাক, জায়নামাজ ও তাসবিহ রয়েছে। কিছু চকলেট দেখিয়ে আবরারের মা বলেন, ‘আবরার ঘুমানোর সময় চকলেট মুখে দিয়ে ঘুমাত।’ এইগুলো পাঁচ বছর ধরে আগলে রেখেছেন তিনি। হাতঘড়ির কাটা বন্ধ হয়ে গেছে। সেটিও দেখালেন আর তিনি বললেন, ‘আর কতদিন চলবে।’
রোকেয়া খাতুন জানান, আবরার সব সময় দেশের ভালোর জন্য লিখতেন। দেশ নিয়ে ভাবতেন। দেশের স্বার্থে ভালো কিছু লিখেই তিনি একটি দলের কাছে শত্রু হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আবরার কোনো রাজনীতি করত না। তাহলে কেন তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর যারা হত্যা করল তারাতো তারই বন্ধু ছিল। তারা কী দেশের ভালো চাইতো না?’
আবরারে মা বলেন, ‘হত্যা মামলার রায় হয়েছে। আসামিদের ফাঁসি হয়েছে। কেউ কেউ পলাতক রয়েছে। সব আসামিদের দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের জোর দাবি জানাই।’
আবরার ফাহাদকে নিয়ে ছোট ভাইয়ের মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাস
আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে ফেসবুকে একটি মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ।
রোববার রাতে নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনি লেখেন, ২০১৯ সালের আজ অর্থাৎ ৬ অক্টোবর ভাইয়া ঢাকাতে যায়। ২৬ সেপ্টেম্বরে কুষ্টিয়াতে আসার পরই ইলিশ আর ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে দুটি পোস্ট দিয়েছিল। সেদিন আম্মু নিজে ভাইয়াকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসছিল। এরপর মাত্র ১৩-১৪ ঘণ্টার মধ্যে ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। আর ২০ ঘণ্টা পরই বাসায় আসে মৃত্যুর সংবাদ।
সেদিন সকালে যাওয়ার আগে ৯টার দিকে আম্মু আমাকে ডেকেছিল। ‘ভাইয়া চলে যাচ্ছে, ওঠ’। কিন্তু ভাইয়া বলে, ‘না থাক, অনেক রাতে ঘুমাইছে ঘুমাতে দাও। আমি চলে গেলাম। তুই বেশিদিন থাকিস না, তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে আসিস’।
যাওয়ার আগের রাতে আম্মুকে ভাইয়া বলেছিল, ‘আম্মু অনেক ছারপোকা কামড়ায়। পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দাও তো। কোনো দাগ হয়ে গেছে নাকি? আচ্ছা, তোমার কাছে কি এমন কোনো ওষুধ আছে, যা লাগালে আর কামড়াবে না আমাকে’।