এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে ৬ লাখ ৬৬০ জন শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। এর মধ্যে তিন লাখ ২৪ হাজার ৭১৬ জন ছাত্র এবং ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৪৪ জন ছাত্রী।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুপুর ২টার দিকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার সভাকক্ষে বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দকার এহসানুল কবির এ তথ্য জানিয়েছেন।

এর আগে, দুপুর ২টায় ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড একযোগে এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ করেছে। 

বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, এবার মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ শিক্ষার্থী; আর গতবারের তুলনায় কমেছে ৪২ হাজার ১২৭।

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে গড় পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। সে হিসাবে পাসের হার অনেক কমেছে।

এবারও ছাত্রীদের পাসের হার ৭১.০৩ শতাংশ এবং ছাত্রদের পাসের হার ৬৫.৮৮ শতাংশ। সে হিসাবে এবারও পাসের হারে এগিয়ে রয়েছেন ছাত্রীরা। এ নিয়ে টানা ১০ বছর এসএসসিতে পাসের হারে এগিয়ে ছাত্রীরা।

দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে সারাদেশে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। সে হিসাবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ব্যাপক হারে কমেছে।

এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ১০ এপ্রিল। পরীক্ষা শেষ হয় ১৩ মে। চলতি বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় ১৪ লাখ ৯০ হাজার ১৪২ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ছাত্র ৭ লাখ ১ হাজার ৫৩৮ জন এবং ছাত্রী ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৪ জন।

এছাড়াও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৭২৬ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩১৩ জন পরীক্ষার্থী ছিল।

২০০৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় এবারের চেয়ে কম পাসের হার ছিল। সে বছর পাস করেছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ, ১৬ বছর আগেই সেই ফলাফলের আবর্তে ফিরেছে এসএসসির ফল।

শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, এটিই প্রকৃত ফল। বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হতো। ফল প্রকাশের একদিন আগেও শিক্ষা উপদেষ্টা গণমাধ্যমকে এমন বক্তব্য দেন। কাউকে বাড়তি নম্বর বা গ্রেস মার্কস না দেওয়ায় ‘প্রকৃত ও সত্য’ ফল উঠে এসেছে বলে দাবি বোর্ড কর্মকর্তাদের।

‘এবার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফল তৈরির অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছি। মেধার সঠিক মূল্যায়নই ফলাফলে উঠে এসেছে।’— শিক্ষা উপদেষ্টা

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এমন নিম্নমুখী ফলাফল শিক্ষাখাতের জন্য মোটেও সুখকর নয়। কোনো ব্যাখ্যায়ই এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখানোর সুযোগ নেই। বিপর্যয়ের কারণগুলো সূক্ষ্মভাবে খতিয়ে দেখে সেই ঘাটতি পূরণে চেষ্টা করতে হবে।

২০০৮ সালে দেশে জাতীয় নির্বাচন দেয় ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিনের সরকার। বহুল আলোচিত এক-এগারো সরকারের অধীনে সেটি ছিল সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষা। ২০০৯ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১১টি বোর্ডে গড় পাসের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। সে বছর মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লাখ ২৩ হাজার ৪৮৪ জন। পাস করে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ৩৯০ জন। ফেল করেছিল ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৪ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৮২ হাজার ২১২ জন।

১৬ বছর পর সেই একই ধারার ফলাফল দেখা গেছে এবার। ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। চলতি বছর দেশের ৩ হাজার ৭১৪টি কেন্দ্রে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন। পাস করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ জন। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন।

শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার এক লাফে প্রায় ১৩ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। সে বছর গড় পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ৮০ শতাংশের ওপর পাসের হার দেখা যায়।

২০১১ সালে পাসের হার দাঁড়ায় ৮২ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০১২ সালে ৮৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৮৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সাল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ, ২০২০ সালে ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০২১ সালে ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ (করোনার বছরে অটোপাস), ২০২২ সালে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমার বিষয়টি এবার ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরারের ভাষ্য, ‘এবার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফল তৈরির অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছেন তারা। ফলে মেধার সঠিক মূল্যায়নই ফলাফলে উঠে এসেছে।’

‘রাজনৈতিক কারণ তো আছেই। পাশাপাশি আরও কিছু কারণে ফল বিপর্যয় হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখাতে বিগত সরকারের সময় পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হতো।’—ঢাবি অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবর রহমান

ফল প্রকাশের আগের দিনই তিনি এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল যে খারাপ হবে, তার ইঙ্গিত দেন। গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘গত ১৬ বছরে যে সরকার ছিল, তাদের আমলে সরকারের সাফল্য দেখানোর জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বাড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হতো। এমনকি সে ফলাফল প্রকাশ নিয়ে এক ধরনের ফটোসেশনের আয়োজন ছিল রাষ্ট্রপ্রধানের। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা পরীক্ষার ফলাফলের বই-পত্র নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতেন এবং প্রধানমন্ত্রী তখন তাদের নিয়ে ফটোসেশন করে রেজাল্ট প্রকাশ করতেন। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার এটাকে বাহুল্য মনে করছে। এটা থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতার প্রকৃত মূল্যায়নে শিক্ষা বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।’

ফল ঘোষণার অনুষ্ঠানে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মোর্চা বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, ‘বাড়তি কোনো নম্বর বা গ্রেস কাউকে দেওয়া হয়নি। নির্দিষ্ট নম্বর পেলে একটু বাড়িয়ে দিয়ে কাউকে জিপিএ-৫ দিয়ে দেওয়ার পথে আমরা হাঁটিনি। সরকারের নির্দেশনা ছিল সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করা, সেটিই আমরা করেছি। উদারনীতি পরিহার করায় ফলাফল কিছুটা নিম্নগামী।’

দেশের শিক্ষাখাত কতটা এগিয়েছে, তা তুলে ধরতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল বলে মনে করেন অনেক শিক্ষাবিদ। এটিকে তারা একেবারে দৃশ্যমান বলেও উল্লেখ করেন। ফলে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ফলাফলেও পতন ঘটলো। যদিও শিক্ষাখাত নিয়ে এমন রাজনীতি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবর রহমান বলেন, রাজনৈতিক কারণ তো আছেই। পাশাপাশি আরও কিছু কারণে এবার এসএসসির ফল বিপর্যয় হয়েছে। আগে এ অভিযোগটা আমাদের কানে আসতো যে, শিক্ষায় বিগত সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করছে। সেটার দৃশ্যমান কিছু তো একটা দেখাতে হবে। এজন্য পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হতো

একই সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় পরীক্ষায় খারাপ করতে পারে বলেও মনে করেন অধ্যাপক মজিবর। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের অবস্থা স্থিতিশীল ছিল না। এ আন্দোলনে এসএসসি পরীক্ষার্থী অনেকে অংশ নিয়েছে। পরবর্তীসময়ে তারা তো স্বাভাবিক ছিল না। তারা শকড ছিল, মানসিকভাবে অস্থিরতায় ভুগেছে। ফলে পরীক্ষায় খারাপ ফল করে থাকতে পারে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *