সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৬২৬ জন: আইএসপিআর

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। প্রাণরক্ষায় সেনানিবাসের ভেতরে রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৬২৬ জনকে আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

রোববার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। এ সময় প্রাণনাশের আশঙ্কায় কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিবিধ নাগরিকরা সেনানিবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ, জীবন রক্ষা ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে জীবন বিপন্ন ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন অসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ২৮ জন পুলিশ অফিসার, ৪৮৭ জন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিবিধ ১২ জন ও ৫১ জন পরিবার-পরিজনসহ (স্ত্রী ও শিশু) সর্বমোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় প্রদান করা হয়।

আইএসপিআর জানায়, পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ত্যাগ করেন। আশ্রয় প্রদানকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে এ পর্যন্ত ৪ জনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বর্তমানে আশ্রয়প্রাপ্ত ৩ জন তাদের পরিবারের ৪ জন সদস্যসহ মোট ৭ জন সেনানিবাসে অবস্থান করছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে।

আইএসপিআর আরও জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের পাশাপাশি বিচার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে নিরপেক্ষ ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এক্ষেত্রে, গুজবে কান না দিয়ে সবাইকে ধৈর্যশীল ও সহযোগী মনোভাব প্রদর্শন করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে। দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনসাধারণের পাশে আছে এবং থাকবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা ও মিরপুর সেনানিবাসসহ দেশের প্রত্যেকটি সেনানিবাসে কম-বেশি মানুষ ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেনাবাহিনী যাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সাবেক মন্ত্রী ও এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও রয়েছেন। এই সংখ্যা আনুমানিক ৪০০ বা তার বেশিও হতে পারে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঢাকায় এই সংখ্যা ৫০ বা তার কাছাকাছি। বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

সেনাবাহিনী ও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। অনেক পুলিশ সদস্য কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেন। ‍পুলিশের সক্ষমতা না থাকায় ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে সেনা আশ্রয়ে থাকা ব্যক্তিদের একসঙ্গে ছাড়া সম্ভব হয়নি। সেটা বাস্তবসম্মত নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ ছেড়ে দেওয়ার পর যারা নানা অপরাধে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, জিজ্ঞাসাবাদ করা ও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার ওপর ‍গুরুত্ব দিয়ে তাদেরকে একের পর এক ছাড়া হচ্ছে। সকল পুলিশ সদস্য এরই মধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন। সক্ষমতা বাড়তে থাকায় সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নেওয়া বেশ কয়েকজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। 

বিগত সরকারের মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে থাকার বিষয়টি জানিয়েছে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও। গত ১৩ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, জীবন বিপন্ন হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনেককেই সেনাবাহিনী আশ্রয় দিয়েছে। তাদের প্রতি যদি কোনো অভিযোগ থাকে, মামলা হয় তাহলে তারা শাস্তির আওতায় যাবেন। কিন্তু অবশ্যই আমরা চাইব না যে, বিচারবহির্ভূত কোনো কাজ বা তাদের ওপর হামলা হোক। তাদের জীবনের হুমকি আছে, সেটার জন্য আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। সে যে দলেরই হোক, যে মতেরই হোক, যে ধর্মের হোক, সেটা (নিরাপত্তা) আমরা দেখব। 

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পরপরই ৫ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ৬ ঘণ্টা বন্ধ রাখার কথা জানায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। ফলে যারা পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাদের অনেকেই তখন চেষ্টা করেও তা পারেনি। এমনকি পরের দিনগুলোতে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছেন। ৬ আগস্ট সকালে পুলিশ সদর দপ্তরের এক বার্তায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইমিগ্রেশন শাখা জানায়, ‘দেশের সকল ইমিগ্রেশন পোস্টে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করায় অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন হাই প্রোফাইল ব্যক্তিবর্গ যেমন- সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়াকর্মীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ 

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ কর্মকর্তা বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ইমিগ্রেশন থেকে তাদেরকে সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেরাই আশ্রয় চাইলে তাদেরকে সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।

৫ আগস্ট ‍পুলিশের তৎকালীন আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ও ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সেনানিবাসে আশ্রয় নেন। পরে এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম ও ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকেও সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে নেওয়া হয়। বিপ্লব কুমার বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ওই সময় তাকে আটক করা হয়। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ লাপাত্তা। 

হারুন ও বিপ্লবের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেন, ‘তারা এখনও কাজে যোগ দেননি। আর তাদের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। এ ছাড়া ডিএমপির প্রায় সকল সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। তারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন।’ 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *