■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির রেগান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যাত্রীবাহী বিমানের মধ্যে মাঝ আকাশে সংঘর্ষে সব আরোহী নিহত হয়েছেন। বিমানটিতে ক্রুসহ ৬৪ জন মানুষ ছিলেন। অপরদিকে হেলিকপ্টারে ছিলেন তিন সেনা। সংঘর্ষের পর দুটি উড়োজাহাজই পোটোম্যাক নদীতে পড়ে যায়।
ওয়াশিংটন ডিসির ফায়ার সার্ভিস প্রধান জন এ ডনলি বলেছেন, “আমরা মনে করছি না কেউ বেঁচে আছেন। এখন পর্যন্ত বিমান থেকে ২৭টি এবং হেলিকপ্টার থেকে একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।”
ফায়ার সার্ভিসের প্রধান আরও জানিয়েছেন, বুধবার রাত ৮টা ৪৮ মিনিটের দিকে তারা দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবগত হন। ওই সময় তাৎক্ষণিকভাবে যেসব উদ্ধারকারী গিয়েছিলেন তারা বিরূপ আবহাওয়ার মুখোমুখি হন। তিনি বলেন, “আবহাওয়া খুবই খারাপ ছিল। উদ্ধারকারীরা গিয়ে তীব্র বাতাস, নদীর পানিতে বরফ জমা দেখতে পান। তারা সারারাত এমন পরিস্থিতিতেই কাজ করেছেন।”
নদীর যে স্থানে বিমানটি পড়েছে সেখানে কোমড় সমান পানি। তবে এটি নদীতে টুকরো টুকরো হয়ে উল্টো হয়ে পড়ে। ফলে সংঘর্ষের পরও যদি কেউ বেঁচে থেকে থাকেন, তিনিও হয়ত বিমান উল্টে পড়ার কারণে মারা যান। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় সবমিলিয়ে ৬৭ জনের মৃত্যু হওয়ার মাধ্যমে ২৪ বছর পর নিজেদের ইতিহাসে বড় বিমান দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করল যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে দুর্ঘটনার পর পর নিকটবর্তী বিমানবন্দরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর এটি আবারও চালু করে দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর জয়েন্ট টাস্কফোর্স-ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিওনের গণমাধ্যমবিষয়ক প্রধান হেদার চাইরেজ সিবিএস নিউজকে বলেন, সামরিক হেলিকপ্টারটির প্রশিক্ষণ ফ্লাইট ছিল।
যাত্রীবাহী বিমানটিতে একাধিক আইস স্কেটার, তাদের পরিবারের সদস্য ও কোচরা উইচিটার এক ক্যাম্প থেকে ফিরছিলেন। তাদের মধ্যে রাশিয়ায় জন্ম নেওয়া সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইয়েভগেনিয়া শিশকোভা ও ভাদিম নৌমভও ছিলেন।
এক পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, ডুবুরি দল উড়োজাহাজটির দুটি ডেটা রেকর্ডারের একটি উদ্ধার করেছে।
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে দুর্ঘটনায় জড়ানো ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের বেতার বার্তা থেকে জানা গেছে, হেলিকপ্টারটির পথে যে উড়োজাহাজটি ছিল, তা হেলিকপ্টারের ক্রুরা জানতেন। পরে ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও হেলিকপ্টার ক্রু এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, দেখে মনে হচ্ছে, এটা ঠেকানো যেত। ভালো হলো না।
ইতোমধ্যে বিমানবন্দরে স্বজনের ভিড় জমেছে। তারা বলেছেন, ঘটনাটির বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য পাননি। বরং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকেই বেশি তথ্য পাচ্ছেন তারা।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে উড়োজাহাজ-হেলিকপ্টার সংঘর্ষের ‘ভয়াবহ দুর্ঘটনা’ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। দুর্ঘটনার পর জরুরি সাড়াদান কর্মীদের ‘অবিশ্বাস্য’ কর্মতৎপরতার জন্য তিনি তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি–সম্পর্কিত আরও তথ্য পেলে পরবর্তী সময়ে তা বিস্তারিতভাবে জানাবেন তিনি।
দুর্ঘটনার সময় জর্জ ওয়াশিংটন পার্কওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন এরি শুলম্যান। তিনি উড়োজাহাজটিকে বিধ্বস্ত হতে দেখেছেন। এরি শুলম্যান এনবিসি ওয়াশিংটনকে বলেন, ‘শুরুতে উড়োজাহাজটির অবতরণ স্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ সেটি ডান দিকে বাঁক নেয় এবং তার নিচের অংশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে স্ফুলিঙ্গ নির্গত হতে থাকে, যা পুরো উড়োজাহাজকে আলোকিত করে।’
শুলম্যান আরও বলেন, তিনি তখন বুঝতে পারেন কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে। কারণ, রাতের বেলা অবতরণকালে উড়োজাহাজের নিচের অংশ এতটা দৃশ্যমান হওয়ার কথা নয়।
বিবিসি জানায়, দুর্ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটির এক যাত্রীর স্বামী হামাদ রাজা তাঁর আরোহী স্ত্রীকে স্বাগত জানাতে এবং এগিয়ে নিতে রিগ্যান ওয়াশিংটন জাতীয় বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। হামাদ রাজা জানান, স্ত্রীর জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি, এমন সময় আমেরিকান এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার খবর পান তিনি।
গত প্রায় ১৬ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এটিই প্রথম সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। নিউজউইক জানায়, এর আগে সর্বশেষ সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর এই নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
১৯৮২ সালে পটোম্যাক নদীর ওপর ফোরটিন্থ স্ট্রিট ব্রিজে এয়ার ফ্লোরিডা ফ্লাইট ৯০ বিধ্বস্ত হয়েছিল। এই ঘটনায় ৭০ যাত্রী এবং ৪ ক্রু নিহত হন। শুধু চার যাত্রী এবং একজন ক্রু বেঁচে গিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া যত বিমান দুর্ঘটনা
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মাঝ আকাশে মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে যাত্রীবাহী এক উড়োজাহাজের। সংঘর্ষের পরে বিমানটি পাশের নদীতে পড়ে যায়। স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট রিগ্যান ওয়াশিংটন ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়েতে অবতরণের সময় এ ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায় ৬৭ জন আরোহীর সবাই মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের পর থেকে ঘটে যাওয়া অন্যতম প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা এটি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন বোর্ড এবং ফ্লাইট সেফটি ফাউন্ডেশনের অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী গত ২৫ বছরের যুক্তরাষ্ট্রের দশটি প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনার তালিকা তুলে ধরা হল—
২০০৯
কলগান এয়ারের একটি টার্বোপ্রপ বিমান নিউইয়র্কের বাফেলোতে অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে বিমানে থাকা ৪৯ জনের মৃত্যু হয়। আর বিমানের বাইরের একজন নিহত হন।
২০০৬
যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি রাজ্যের লেক্সিংটন থেকে উড্ডয়নের সময় রানওয়েতে ছিটকে পড়ে কমএয়ারের একটি রিজওনাল জেট। এতে বিমানের ৫০ জন আরোহীর মধ্যে ৪৯ জন মারা যান।
কমএয়ারের একটি রিজিওনাল জেট হচ্ছে একটি ছোট আকারের যাত্রীবাহী বিমান, যা সাধারণত ছোট বা মাঝারি দূরত্বের রুটে চলাচল করে।
২০০৫
ফ্লোরিডার মায়ামি থেকে উড্ডয়নের পর চক’স ওশান এয়ারলাইনের একটি টার্বোপ্রপ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে ২০ জন আরোহীর সবাই নিহত হন।
২০০৪
করপোরেট এয়ারলাইনসের একটি টার্বোপ্রপ বিমান মিজৌরির কার্কসভিলে অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পড়ে, এতে ১৫ জনের মধ্যে ১৩ জন নিহত হন।
২০০৩
ইউএস এয়ারওয়েজ এক্সপ্রেসের একটি টার্বোপ্রপ বিমান উত্তর ক্যারোলিনার শার্লটে উড্ডয়ন করার পর দুর্ঘটনায় পড়ে। এ দুর্ঘটনায় বিমানের ২১ জন আরোহী মারা যান।
নভেম্বর ২০০১
আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি জেট নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে ২৬০ জন নিহত হন এবং বিমানের বাইরে পাঁচজন মারা যান।
৯ / ১১,২০০১
যুক্তরাষ্ট্রের বিমান দুর্ঘটনার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় হতাহত হন ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে। সেদিন চারটি বিমান ধ্বংস হয়।
আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি হাইজ্যাক করা বিমান বোস্টন থেকে ছেড়ে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনে বিধ্বস্ত হয়, এতে ৯২ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। বিধ্বস্তের সময় আশপাশে থাকা ১ হাজার ৬০০ জন মারা যান।
আরেকটি হাইজ্যাক করা ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের জেটও বোস্টন থেকে উড্ডয়ন করে এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত হানে, এতে ৬৫ জন যাত্রী নিহত হন। আর দুর্ঘটনার স্থানে থাকা প্রায় ৯০০ জন মারা যান।
ওয়াশিংটন-ডুলেস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে তৃতীয় একটি হাইজ্যাক করা আমেরিকান এয়ারলাইনসের জেট পেন্টাগনের ওপর বিধ্বস্ত হয়, এতে ৬৪ জন যাত্রী নিহত হন। দুর্ঘটনার স্থানে থাকা প্রায় ১২৫ জন মারা যান।
আর ইউনাইটেড এয়ারলাইনের হাইজ্যাক করা জেটটি নিউজার্সি থেকে উড্ডয়ন করে পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়, এতে ৪৪ জন যাত্রী নিহত হন।