■ শেরপুর প্রতিনিধি ■
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শুক্রবার (৪ অক্টোবর) থেকে শুরু হওয়া বন্যায় এখন পর্যন্ত ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই ভাইসহ এ পর্যন্ত মারা গেছে ৭ জন। নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছানোয়ার হোসেন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের পর এবার নকলা ও শেরপুর সদর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে নতুন করে ঢলের পানি প্রবেশ করেছে।
রোববার দুপুর পর্যন্ত শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার আরও ছয়টি ইউনিয়নের অনেকগুলো গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। উজানের ঢল ভাটির দিকে নামতে শুরু করায় ছোটবড় বিভিন্ন বাঁধ ও সড়কে ফাটল ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। শেরপুর থেকে তিনআনী হয়ে নালিতাবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের রানীগাঁও সেতুর কাছে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় শনিবার দুপুর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
এছাড়া শেরপুর থেকে গাজীর খামার হয়ে নালিতাবাড়ীগামী রাস্তার কলসপাড় ইউনিয়নের চারটি জায়গার ওপর দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ওই সড়কে যানবাহন ও মানুষ ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।
জানা গেছে, জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রায় ৩০টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ায় গতকাল শনিবার থেকে সেনাবাহিনী উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। দুর্গতদের উদ্ধারে কাজ চলছে। এছাড়া শুকনো খাবারসহ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
তিনি জানান, ভারী বর্ষণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর খলিশাকুড়ির খলিলুর রহমান (৬৫), আন্ধারুপাড়ার ইদ্রিস আলী (৬৬), নিশ্চিন্তপুর কুতুবাকুড়া গ্রামের দুই ভাই আলম (১৭) ও হাতেম (৩০) ও বাঘবেড় বালুরচরের ওমেজা বেওয়া নামে একজন পানিতে ডুবে মারা গেছেন। এছাড়া ঝিনাইগাতীর সন্ধাকুড়া থেকে একজন উদ্ধার হয়েছে। তবে তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। এদিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে বন্যায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে অভিযান চললেও পানির প্রবল স্রোত আর পর্যাপ্ত নৌযানের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কাজ।
শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোববার জেলার ভোগাই নদীর নাকুগাঁও পয়েন্টে পানি ১ সেন্টিমিটার, নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৪৮ সেন্টিমিটার এবং চেল্লাখালীর ২৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়াও অপর দুটি পাহাড়ি নদী মহারশি ও সোমেশ্বরীর পানি এখনও বিপৎসীমার সমান রয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেয়েছে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী ও দশানী নদীর।
শেরপুর সদরের গাজির খামার ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলেছেন, গতকাল শনিবার মধ্য রাত থেকে প্লাবিত হয়েছে গাজির খামারসহ আশে পাশের কয়েকটি ইউনিয়ন।
নকলা পৌর এলাকাসহ প্রায় সব ইউনিয়নেই প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালে, সিলিংয়ে ও মাচায়।
আরও জানা গেছে, বন্যার কারণে শেরপুর নাকুগাঁও স্থলবন্দর স্থবির হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে জেলার অধিকাংশ সড়ক। বিধ্বস্ত হয়েছে অসংখ্য গ্রামীণ পাকা ও কাঁচা সড়ক। পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন ও উঠতি আমনের খেত। বিভিন্ন স্থানে বানের পানিতে ধসে ও ভেসে গেছে কাঁচা ঘর-বাড়ি। পানিতে ভাসছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র। এসব এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও তা অপর্যাপ্ত।
নিম্নাঞ্চলে ঢলের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নালিতাবাড়ী-নকলা সড়কের ওপর দিয়ে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। ওই সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যান চলাচল করলেও শেরপুর-নালিতাবাড়ী ভায়া গাজীর খামার সড়কে ঢলের কারণে শনিবার থেকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নালিতাবাড়ী-শেরপুর ভায়া তিনানী সড়কটির রানীগাঁও এলাকায় ঢলের তোড়ে ভেঙে একদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর সড়ক ও জনপথ বিভাগ ভাঙা অংশে রোববার বালির বস্তা ফেলে সাময়িকভাবে সড়ক যোগাযোগ চালুর চেষ্টা করছে। উজানের বাড়িঘর থেকে বন্যার নেমে যাওয়ায় নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে ঢলের তাণ্ডবে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে ওঠেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, ডুবে গেছে ফসলি জমি। গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
তবে শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাকিবুজ্জামান খান বলেন, আগামীকাল সোমবারের ভেতর কমবে সব নদীর পানি, উন্নতি হবে বন্যা পরিস্থিতির।
জেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ পর্যন্ত জেলার সাড়ে ৩৫ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের আবাদ পানিতে তলিয়ে গেছে। সাড়ে ৯ শ হেক্টর জমির সবজির আবাদ পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।