তিন পার্বত্য জেলায় চলছে অবরোধ

■ খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান প্রতিনিধি ■

চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে চলছে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ। শনিবার সকাল ৬টা থেকে শুরু হওয়া ৭২ ঘণ্টার এই অবরোধ কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিএইচটি ব্লকেড’।

অবরোধের কারণে তিন জেলায় দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলছে না। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

গত দুইদিনে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ৪ জন নিহত হয়। আহত হয় দুই পক্ষের অন্তত ৫৫ জন। হতাহতের প্রতিবাদ ও দোষীদের শাস্তি দাবিতে শুক্রবার ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র–জনতার’ ব্যানারে ৭২ ঘণ্টার এই অবরোধের ডাক দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে গতকাল প্রতিবাদ সমাবেশে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।

এই কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামের সংগঠন। এছাড়া পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) অবরোধে সমর্থন জানিয়েছে।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে।

দীঘিনালা উপজেলায় সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, পানছড়ি ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।

আগের দিনের ঘটনার জেরে গতকাল খাগড়াছড়ির পাশাপাশি রাঙামাটিতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। খাগড়াছড়িতে তিন পাহাড়ির মৃত্যু ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সকালে রাঙামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন পাহাড়িরা। মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়সহ ৩০ থেকে ৪০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সংঘর্ষে একজন নিহত এবং আহত হয়েছেন দুই পক্ষের অন্তত ৫৫ জন। নিহত ব্যক্তির নাম অনিক কুমার চাকমা। তিনি কর্ণফুলী ডিগ্রি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। এ ঘটনার প্রতিবাদে ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দেওয়া হয়।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রাঙামাটিতে সকালে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পুলিশ সেনাবাহিনী বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ টহল টিম শহরে কাজ শুরু করেছে।

রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জানান, আমরা মাঠে আছি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি।

রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সাদিয়া আক্তার জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ৫০ জনের মতো আহত হাসপাতালে এসেছে। যাদের মধ্যে অন্তত ৭ জনের অবস্থা গুরুতর।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দুপুর দেড়টা থেকে রাঙামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

রাঙামাটিতে পরিবহন ধর্মঘট

রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডেকেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা। জেলায় সংঘর্ষের ঘটনায় বাস, সিএনজি, ট্রাক ভাঙচুর ও শ্রমিক আহতের প্রতিবাদে এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন তারা। শনিবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে ধর্মঘট।

শুক্রবার রাতে এক যৌথ সভায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানান নেতারা।

সভায় উপস্থিত ছিলেন, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি ট্রাক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুর রহিম আকাশ, মাইক্রোবাস মিনিবাস সমিতির অর্থ সম্পাদক দিদারুল আলম, রাঙামাটি সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন প্রমুখ।

তারা জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় ৩টি বাস, ৪টি সিএনজি, ১২টি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া আহত হয়েছেন বাসচালক ও হেলপার ৬ জন, সিএনজি চালক ৩০-৩৫ জন এবং ট্রাক চালক ১২ জন। এদের মধ্যে ২ জন সিএনজি চালক গুরুতর আহত হয়েছেন।

রাঙামাটি সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান জানান, যানবাহনের ক্ষতি করা হয়েছে। দুই শ্রমিককে কুপিয়ে জখমের পাশাপাশি অনেককে নানাভাবে আহত করা হয়েছে। এর প্রতিবাদেই ধর্মঘট। সুষ্ঠু সমাধান ও ক্ষতিপূরণ না পাওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে বলেও জানান তিনি।

একইভাবে রাঙামাটি ও বান্দরবানের সঙ্গেও চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। রাঙামাটিতে চলাচলকারী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও বান্দরবানের পূরবী ও পূর্বাণী বাস চলছে না। এ ছাড়া ঢাকায় চলাচলকারী বাসও ছাড়েনি। তিন জেলার সঙ্গে পণ্য পরিবহনের ট্রাক ও পিকআপ গাড়ি চলাচলও বন্ধ রয়েছে।

রাঙামাটির ভেদভেদী এলাকায় দেখা যায়, শহরের স্বল্প দূরত্বে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশাও বন্ধ রয়েছে। অবরোধে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। সকাল ১০টা পর্যন্ত এগুলো বন্ধ থাকতে দেখা গেছে।  

খাগড়াছড়ির সঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকার যান চলাচল বন্ধ

অবরোধে সকাল থেকে খাগড়াছড়ির সঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকার যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম যাত্রাপথে চলাচলকারী শান্তি পরিবহনের বাস চলছে না। আজ সকালে চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেনের মোড়ের কাউন্টার থেকে কোনো টিকিট বিক্রি করা হয়নি। কাউন্টারে গিয়ে কয়েকজন যাত্রী ফেরত যান। একইভাবে একই রুটে চলাচলরত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) বাসও সকালে কোনো প্রান্ত থেকে ছাড়েনি। আন্ত–উপজেলায় চলাচলকারী জিপ বা সিএনজিচালিত অটোরিকশাও চলছে না।

একইভাবে রাঙামাটি ও বান্দরবানের সঙ্গেও চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। রাঙামাটিতে চলাচলকারী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও বান্দরবানের পূরবী ও পূর্বাণী বাস চলছে না। এ ছাড়া ঢাকায় চলাচলকারী বাসও ছাড়েনি। তিন জেলার সঙ্গে পণ্য পরিবহনের ট্রাক ও পিকআপ গাড়ি চলাচলও বন্ধ রয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চল পরিদর্শনে ৩ উপদেষ্টা

খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি পরিদর্শন করতে গেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা।

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে তারা সেখানে বেলা ১১টায় পৌঁছান।

তিন উপদেষ্টা হচ্ছেন— স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা সাবেক রাষ্ট্রদূত (অব.) সুপ্রদীপ চাকমা, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফ। পরিদর্শনে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময় করার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, বেলা সোয়া ১১টায় রাঙ্গামাটির রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মতবিনিময়। বিকেল ৩টায় খাগড়াছড়ির রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মতবিনিময় করবেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *