স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন ৮ বিশিষ্টজন

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৫ পাচ্ছেন আট বিশিষ্টজন। শিগগির স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের তালিকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৫-এর জন্য মনোনীত বিশিষ্টজনদের মধ্যে আছেন- মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী (মরণোত্তর), পপ সম্রাট আজম খান (মরণোত্তর), কবি আল মাহমুদ (মরণোত্তর), রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর, ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ (মরণোত্তর), ভাস্কর নভেরা আহমেদ (মরণোত্তর), বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ও বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ (মরণোত্তর)।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। এটি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেটের ৫০ গ্রাম সোনার পদক, সম্মানীর অর্থের চেক ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।

স্বাধীনতা পুরস্কার দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সরকার ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর এ পুরস্কার দিয়ে আসছে।

গত বছর ১০ জনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

গত ২ মার্চ স্বাধীনতা পুরস্কার দিতে জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা হয়। সভা শেষে কমিটির সভাপতি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘এবার আমরা একুশে পদক যেভাবে দিয়েছি, আমরা একবারই সম্ভবত এ পুরস্কারগুলো দিতে পারবো। কিন্তু দেখেই যেন মনে হয় এ পুরস্কারগুলো অনন্যধর্মী, অন্য বছর এ ধরনের পুরস্কার দেওয়া হয় না। পরেও দেওয়া হবে কি না আমি জানি না।’

কমিটির সদস্য ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘এ পুরস্কারের (স্বাধীনতা পুরস্কার) মহিমা উপলব্ধি করে দল ও গোষ্ঠীগত চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে স্যারের (ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ) নেতৃত্বে আমরা এমন সব নাম সুপারিশ করেছি, আপনারা একুশে পদক দেখে খুশি হয়েছিলেন এ পুরস্কার দেখে আরও খুশি হবেন। মনে হবে পুরস্কার দিতে পেরে আমরা নিজেরা ধন্য হচ্ছি।’

আমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম

বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে।

জামাল নজরুল ইসলামের স্কুলজীবন শুরু হয় কলকাতায়, সেখান থেকে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন, শেষে পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। বিএসসি সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে। এরপর বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ট্রাইপজে তিন বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করেন। ১৯৬০ সালে কেমব্রিজ থেকেই মাস্টার্স। ১৯৬৪ সালে এখান থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ড. ইসলাম অত্যন্ত দুর্লভ ও সম্মানজনক ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ছাত্রজীবনে তাঁর সমসাময়িক ও আজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিস্ময়কর বিজ্ঞান-প্রতিভা স্টিফেন হকিং।

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন। ১৯৭১-৭২ দুই বছর ক্যালটেক বা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৭৩-৭৪ সালে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মনে সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন।

এর মধ্যে জামাল নজরুল ইসলামের অনেক গবেষণা নিবন্ধ বিখ্যাত সব বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৯৮৩ সালে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের কসমোলজিস্টদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। দ্রুত বইটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। পরের বছর কেমব্রিজ থেকেই প্রকাশিত হয় ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি। তাঁর গবেষণা আইনস্টাইন-পরবর্তী মহাবিশ্ব গবেষণায় বিরাট অবদান রেখেছে। তিনি এই ধারায় গবেষণা অব্যাহত রেখে পরবর্তীকালে লেখেন ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স বা মহাবিশ্বের দূরবর্তী ভবিষ্যৎ।

সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ কখনো এক সরলরেখায় এলে পৃথিবীর ওপর তার প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। তবে গবেষণায় প্রফেসর ইসলাম আশার কথাই শুনিয়েছিলেন—সে রকম ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেমব্রিজ এবং পশ্চিমে শিক্ষার গবেষণা ও অধ্যাপনায় থাকাকালে তাঁর বন্ধু ও সুহৃদমহল গড়ে ওঠে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন তাঁর শিক্ষক ফ্রিম্যান ডাইসন, পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান, ভারতের সুব্রহ্মনিয়াম চন্দ্রশেখর, পাকিস্তানের আবদুস সালাম, ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অমিয় বাগচী, তাঁর সহপাঠী জয়ন্ত নারলিকার, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম মার্লিস প্রমুখ। হকিংয়ের কথা তো আগেই এসেছে।

১৯৮৪ সালে প্রফেসর ইসলাম তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। পশ্চিমের উন্নত দেশে ৩০ বছরের অভ্যস্ত জীবন, সম্মানজনক পদ, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, বিশ্বমানের গুণীজন সাহচর্য এবং আর্থিকভাবে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এলেন একেবারে নিজ জেলা চট্টগ্রামে। অতি দামি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দিলেন মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে।

দেশে ফিরে এসে একদিকে জামাল নজরুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা রিচার্স সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস), যেটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে দেশের প্রবীণ পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর এ এম হারুন-অর রশিদ ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে আগত খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী, আপেক্ষিকতত্ত্ববিদ এবং বিশ্ব সৃষ্টি তাত্ত্বিকদের অবদান’ স্মরণ করে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রফেসর ইসলামের শ্রেষ্ঠ কীর্তি আখ্যা দিয়েছিলেন। এখানে তিনি উচ্চতর গবেষণার ছাত্রদের সহায়তার পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছেন, যাতে অনেক নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পণ্ডিতজন যোগ দিয়েছেন।

উন্নয়নের নামে প্রকৃতি, পরিবেশ ও গরিবের স্বার্থবিরোধী কাজ দেখলে তিনি হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতেন। একপর্যায়ে তিনি এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হতেন না; বহুতল ভবন, যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ এবং বঞ্চনা ও বৈষম্যের অর্থনীতি, কালোটাকা ও অবৈধ সম্পদের ছড়াছড়ির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন।

২০১৩ সালের ১৬ মার্চ মধ্যরাতে এ মহান বিজ্ঞানী আমাদের ছেড়ে গেছেন।

মৃত্যুর ১৪ বছর পর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন পপসম্রাট আজম খান

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পপসম্রাট আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে। তার পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। 

আজম খান ১৯৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সাল থেকে তিনি পরিবারের সঙ্গে কমলাপুরে থাকা শুরু করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আজম খান ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। 

১৯৭০ সালে তিনি টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন।

১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আজম খান। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের সেকশন ইনচার্জ।

সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। 

একসময় যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল ‘অপারেশান তিতাস’।

স্বাধীনতার পর তার ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ আলোড়ন তুলেছিল। ১৯৭২ সালে ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি বিটিভিতে প্রচারের পর ব্যাপক প্রশংসিত হয়। 

১৯৭৪ সালে বিটিভিতে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’ শিরোনামের গানটি গেয়ে আলোচনায় আসেন আজম খান।

১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম ক্যাসেট ‘এক যুগ’। ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের প্রযোজনায় তার গাওয়া গানের প্রথম সিডি বের হয় ১৯৯৯ সালের ৩ মে।

আজম খানের গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় গানের তালিকায় রয়েছে: ‘আমি যারে চাইরে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অ্যাকসিডেন্ট’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘পাপড়ি’, ‘বাধা দিও না’, ‘যে মেয়ে চোখে দেখে না’ ইত্যাদি।

১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে হিরামন সিরিজের নাটকে অভিনয় করেছিলেন আজম খান। ২০০৩ সালে শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আজম খান।

২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মডেল হয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সালে কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছিলেন এই পপসম্রাট।

২০১০ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালের ৫ জুন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান আজম খান। তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

২০১৯ সালে আজম খানকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এবার তিনি পেতে যাচ্ছেন স্বাধীনতা পদক।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *