■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির পরিসংখ্যার অনুযায়ী, বিগত ৯ বছরে সারা দেশে ৪ হাজার ২৬৮ জন ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় ২ হাজার ৩২৮ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএমআরএফ) চেয়ারম্যান শেখ খায়রুল আলম সোহেল এ তথ্য জানান।
বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশে, চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে, ২০২৩ সালে ১০৪৯ জন, ২০২২ সালে ৭৯২ জন, ২০২১ সালে ৪৫০ জন, ২০২০ সালে ৩৩০ জন, ২০১৯ সালে ২৪০ জন, ২০১৮ সালে ১৭০ জন, ২০১৭ সালে ১২০ জন ও ২০১৬ সালে ৫০ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ হিসেবে গত নয় বছরে ৪ হাজার ২৬৮ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে দাবি করেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ জেলায়, চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৬৪৭ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে, ২০২৩ সালে ৬৩২ জন, ২০২২ সালে ৩৯৭ জন, ২০২১ সালে ২১২ জন, ২০২০ সালে ১৫৩ জন, ২০১৯ সালে ১১৭ জন, ২০১৮ সালে ৮২ জন, ২০১৭ সালে ৬৫ জন ও ২০১৬ সালে ২৩ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ হিসাব অনুযায়ী গত নয় বছরে ২ হাজার ৩২৮ জন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএমআরএফ) চেয়ারম্যান শেখ খায়রুল আলম সোহেল বলেন, পুরুষের অধিকার ও নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের সংগঠনটি কাজ করছে। আমাদের সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, সারা দেশে গত কয়েক বছর গড়ে প্রায় এক হাজারের অধিক ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রায় ৬-৭শ জনের অধিক পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়। বিবাহিত পুরুষরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সারা দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তবে বাস্তবে নির্যাতনের শিকার পুরুষের সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি। লোকলজ্জা ও সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে অনেক পুরুষ এসব নিয়ে কথা বলতে চান না। এসব ঘটনায় নির্যাতিতদের আইনি সহায়তা দেওয়াসহ নির্যাতন প্রতিরোধে আমরা কাজ করে আসছি।
আইনের অপব্যবহারের ফলে পুরুষ নির্যাতন বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারী নির্যাতন আইন থাকলেও পুরুষ নির্যাতন আইন নেই। ফলে নারী নির্যাতন আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। এতে অনেক পুরুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, মিথ্যা মামলার মধ্য দিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেক পুরুষ এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। কিন্তু লোকলজ্জা ও সম্মান হানির ভয়ে অনেকে তা বলতে পারছে না। এমন নানা অভিযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের সংগঠনের কাছে অনেকে আসছে। তবে তারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হন না।
নারীদের প্রাধান্য দিয়ে অনেক আইন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীদের প্রাধান্য দিয়ে একচেটিয়া অনেক আইন করা হয়েছে। যেমন- দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় আছে, এক জনের স্ত্রী আরেক ব্যক্তির সঙ্গে পরকীয়ায় আসক্ত হলে, ওই নারী দায়মুক্ত আর পুরুষ ব্যক্তিটির ৫ বছরের জেল জরিমানা হবে। অথচ এখানে দুজনই সমান অপরাধী, কিন্তু শাস্তি পাচ্ছে পুরুষ। এ কারণে আমরা চাইছি সমতা। যাতে করে অপরাধী যেই হোকনা কেন তাকে শাস্তি দেওয়া হোক। এ ছাড়া বিয়েতে মোটা অঙ্কের দেনমোহর দিতে বাধ্য করে পরে তা নিয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করা ও মামলা ঠুকে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। কোনো নারী পরকীয়ায় আসক্ত হলে নানা তালবাহানা করে স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনসহ নানা মিথ্যা মামলা করে দেয়। এমনকি পুরুষের ওপর শারীরিকভাবে নির্যাতন পর্যন্ত করে। এসব বিষয়ে পুলিশের কাছে বলেও কোনো সমাধান পায় না, বরং হাসি-ঠাট্টার শিকার হতে হয় পুরুষকে। অথচ এই অভিযোগ কোনো নারী করলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তার পক্ষে অ্যাকশনে যায়। এ কারণে পুরুষ নির্যাতন দমন আইনের দাবি করে আসছি।
স্ত্রী কর্তৃক মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে জেল খেটেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৫ সালে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হলেও স্ত্রী আমার বাড়িতে যেতে রাজি হচ্ছিল না। বিয়ের প্রায় তিন মাস পর এ বিষয়ে চাপ দিলে স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে যৌতুকের মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়। অথচ স্থানীয়রা সবাই এটাকে মিথ্যা মামলা বলেছে। কিন্তু আদালত সেই কথায় কর্ণপাত করেনি। অবশেষে আমাকে জেলে যেতে হলো। পরে জামিনে বেরিয়ে এলে ফের আমার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়া হলো। তবে ওই মামলার তদন্তে নির্যাতনের সত্যতা পায়নি পুলিশ। তবুও আমাকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয়েছে। তখন উপলব্ধি করতে পারি, আমার মতো হাজার হাজার পুরুষ এভাবে হয়রানির শিকার হয়ে আসছে। ফলে মামলার ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেছি। অবশেষে বিয়ের কাবিনের দ্বিগুণ টাকা পরিশোধ করে সেই মামলা মিটমাট করেছি।
এই বিষয়ে মহিলা পরিষদের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসিনা পারভীন বলেন, ‘বর্তমানে আইন নারীদের পক্ষে। এর কারণ হলো- আগে ৯৯ শতাংশ পুরুষ খারাপ ছিল। নারী নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটতো। আইনের কারণে সেটা আগের তুলনায় কমেছে। আর পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টা সেই তুলনায় অনেক কম বলা চলে। তবে কিছু কিছু অসাধু নারী এই আইনের অপব্যবহার করছে। তারা কাবিনের টাকা পাওয়ার জন্য মামলা করে থাকে। তবে এই সংখ্যা অতি নগণ্য।’
সমতার আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকে সমতা বা সমান অধিকারের কথা বলে আসছি। এই আইনের কথা আমরা অনেক আগে থেকে দাবি করে আসছি। কারণ নারী ও পুরুষের সমান অধিকার পাওয়া উচিত। পুরুষ অধিকার ফাউন্ডেশন এই দাবি করে থাকলে আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই।’
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, ‘নারী-পুরুষ উভয়কে সমান অধিকার দেওয়া উচিত। বর্তমান আইন ব্যবস্থার ফলে অনেক নারী মিথ্যা মামলা দিয়ে পুরুষদের হয়রানি করতে পারেন। সব নারী খারাপ নয়, তাদের মধ্যে ভালো-খারাপ রয়েছে। প্রকৃত নারী নির্যাতনের বিষয়গুলোকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে অনেক নারী বিয়েতে বেশি টাকা কাবিন করিয়ে থাকে। পরে সেই টাকা আদায়ের জন্য মামলা দিয়ে হয়রানি করে টাকা আদায় করে। অনেক সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে মামলা দেওয়া হয়। এ কারণে অনেক সময় মিথ্যা মামলার আড়ালে সঠিক বা প্রকৃত মামলাগুলো হারিয়ে যায়। তাই পুরুষের বেলায়ও আইন করা দরকার। যাতে করে পুরুষরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, হয়রানির শিকার না হয়। ফলে আইন পরিবর্তন নয়, আইন মোডিফাই করা দরকার।’
বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের সমাজে পুরুষ একই সঙ্গে কিন্তু নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদে তারা নির্যাতিত হলেও হতে পারে।
তিনি বলেন, গত বছর আমাদের এখানে (বাংলাদেশে) ছোট পরিসরে পুরুষ দিবস উদযাপিত হয়েছে৷ পুরুষ নির্যাতন নিয়ে আমরা এখনো কোন গবেষণা বা পরিসংখ্যান পাইনি। পুরুষরা যত বেশি পুরুষ হিসেবে নির্যাতিত হয়ে থাকেন তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রেণী, অবস্থান ও আর্থ-সামাজিক দুর্বল অবস্থানের কারণে নির্যাতিত হন। একই কারণে নারীও নির্যাতিত হন৷ আমি মনে করি সব নির্যাতনেরই আইনী সুরক্ষা থাকা প্রয়োজন।