:: বরগুনা প্রতিনিধি ::
বরগুনার আমতলীতে সেতু ভেঙে বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস খালে ডুবে নয়জন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে আটজনই সাবেক সেনাসদস্য মাহাবুবুর রহমান সবুজের পরিবারের সদস্য।
শনিবার (২২ জুন) দুপুরে বরগুনার আমতলী উপজেলার হলদিয়া হাট ব্রিজ ভেঙে মাইক্রোবাস ও অটো খালে ডুবে এ ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছেন মাদারীপুরের শিবচরের সাবেক সেনাসদস্য মাহাবুবুর রহমান সবুজও।
এ ঘটনায় নিহতরা হলেন মাহাবুবের ভাই সোহেলের স্ত্রী রাইতি (৩০), মাহাবুবের মা ফরিদা বেগম (৪০), মামি মুন্নি বেগম (৪০), তার সন্তান তাহিয়া (৭), তাসদিয়া (১১), আরেক মামি ফাতেমা বেগম (৪০), রুমি বেগম (৪০)। এ ছাড়া আমতলীর দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া জহিরুল ইসলামের স্ত্রী জাকিয়া এবং মেয়ে রিদি (৫)।
তাঁদের মধ্যে রুকাইয়াত ইসলাম ও জাকিয়া বেগমের বাড়ি আমতলী উপজেলার দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া গ্রামে। আর অপর সাতজনের বাড়ি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কোকরার চর গ্রামে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একই পরিবারের তিনজন হলেন কনের মামাবাড়ির স্বজন মাদারীপুরের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার ও তাঁর দুই মেয়ে তাসফিয়া ও তাহিয়া মেহজাবিন।
আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাখাওয়াত হোসেন নাগরিক নিউজকে দুর্ঘটনায় নিহত ৯ জনের লাশ উদ্ধার করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
নিহতদের পারিবারিক সূত্র জানায়, আমতলী উপজেলার চাওড়া ইউনিয়নের উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের মাসুম বিল্লাহর মেয়ে হুমায়রা আক্তারের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার আমতলী পৌর এলাকার বাসিন্দা সেলিম মাহমুদের ছেলে সোহাগ মিয়ার বিয়ে হয়। শনিবার দুপুরে বরের বাড়িতে বউভাত অনুষ্ঠান ছিল। কনের পক্ষের লোকজন মাইক্রোবাস ও একটি ইজিবাইকে বউভাতের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। বেলা দেড়টার দিকে মাইক্রাবাস ও ইজিবাইকটি দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া-হলদিয়াহাট এলাকায় চাওড়া নদীর ওপর সেতু পার হচ্ছিল। মাঝামাঝি আসতেই সেতুটি ভেঙে গেলে এতে মাইক্রোবাস ও ইজিবাইকটি নদীতে ডুবে যায়।
এ সময় ইজিবাইকে থাকা যাত্রীরা সাঁতরে কিনারে উঠতে পারলেও মাইক্রোবাসের যাত্রীরা নদীতে তলিয়ে যান। তাৎক্ষণিক স্থানীয় লোকজন ওই মাইক্রোবাসে থাকা লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালান। খবর পেয়ে আমতলী উপজেলা সদর থেকে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের দুটি দল দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। পরে মাইক্রোবাসে থাকা কনেপক্ষের ৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলো আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম ও নাসির উদ্দিন বলেন, ‘মাইক্রোবাস ও ইজিবাইকটি মাঝ বরাবর আসতেই সেতুটি ভেঙে পড়ে। এতে মাইক্রোবাস ও ইজিবাইকটি নদীতে পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা চালাই। পরে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এসে উদ্ধারকাজে অংশ নেয়।’
মাইক্রোবাসে থাকা কনেপক্ষের স্বজন সোহেল মিয়া বলেন, ‘মাইক্রোবাসে আমরা কনেপক্ষের ১৬ জন যাত্রী বরের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। পথে হলদিয়া হাট সেতু পার হওয়ার সময় সেটি ভেঙে যায়। এতে মাইক্রোবাস ও ইজিবাইকটি নদীতে পড়ে যায়। নদীতে পড়ে যাওয়ার পর আমরা বের হওয়ার চেষ্টা চালাই। কিন্তু দরজা খুলতে পারিনি। পরে মাইক্রোবাসের জানালার কাঁচ ভেঙে আমরা কয়েকজন অনেক কষ্টে বের হতে পারলেও বেশির ভাগই ভেতরে আটকা পড়ে।’
জীবিত উদ্ধার হওয়া মাহবুব খান বলেন, ‘শুক্রবার আমরা ভাগ্নি হুমায়রা বেগমের বাড়ি হলদিয়া ইউনিয়নের গুরুদল গ্রামে যাই। সেখান থেকে একটি হাইএস মাইক্রোযোগে আজ শনিবার দুপুর ১টার দিকে ভাগ্নি জামাইয়ের বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য রওয়ানা করি। দুপুর দেড়টার দিকে হলদিয়া বাজার সংলগ্ন একটি লোহার সেতু পার হওয়ার সময় মাইক্রোটি মাঝ বরাবর আসার পর আকস্মিক সেতুটি ভেঙে যায়। এরপর আর কিছুই বলতে পারি না। জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালে। আল্লায় মোগো বাঁচাইলেও সব শ্যাষ অইয়া গ্যাছে। এর চাইতে আমাদেরও মইরা যাওয়া ভালো ছিল।’
ঘটনার পর বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু, জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলামসহ জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা উদ্ধার কার্যক্রম তদারক করেন।
সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, মূলত চাওড়া ও হলদিয়া দুই ইউনিয়নের সংযোগ সড়কের এ সেতুটি ভারী যান চলাচলের উপযোগী নয়। তা ছাড়া কয়েক বছর আগে থেকেই সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মূলত এ জন্যই এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে ভারী যান চলাচলের সেতু নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঠিকাদারের শাস্তি দাবিতে বিক্ষোভ
বরগুনার আমতলীতে লোহার সেতু ভেঙে কনেপক্ষের নয়জন যাত্রী নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এক পরিবারের সাতজন। আজ শনিবার বেলা দেড়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার শাস্তি দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
জানা গেছে, আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী অধিদপ্তর ২০০৮-০৯ অর্ধবছরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলার চাওড়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত চাওড়া নদীর ওপর হলদিয়া হাট এলাকায় লোহার সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করে। ওই সেতুর নির্মাণকাজ পায় তৎকালীন হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শহীদুল ইসলাম মৃধা।
অভিযোগ রয়েছে, সেতু নির্মাণকালে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা সেতু নির্মাণ করেছেন। নির্মাণের পাঁচ বছরের মাথায় সেতুর মাঝের বিম ভেঙে যায়। ১০ বছর ধরে ওই ভাঙা সেতু দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন ও চাওড়াসহ উপজেলার অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ চলাচল করে আসছে।
এদিকে এ ঘটনার পরপর সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার বিচার দাবিতে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছে। খবর পেয়ে বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু, জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম সরোয়ার ফোরকান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) তারেক হাসান, সহকারী পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, ওসি কাজী সাখাওয়াত হোসেন তপু ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান মিন্টু মল্লিক বলেন, ‘সেতু নির্মাণকালে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা দায়সারা সেতু নির্মাণ করেছে। ফলে নির্মাণের অল্প দিনের মধ্যেই সেতুর মাঝখানের বিম ভেঙে গেছে। ওই ভাঙা সেতু দিয়ে অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ চলাচল করত। এই ভাঙা সেতু মেরামতের জন্য আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বহুবার জানিয়েছি। কিন্তু তিনি আমলে নেননি। যার ফলে আজ ৯ জনের প্রাণ গেল। ঠিকাদার দায়সারা সেতু নির্মাণ করায় এবং উপজেলা প্রকৌশলী সেতু সংস্কার না করায় তাঁদের শাস্তি দাবি করছি।’
ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা বলেন, ‘আমি যথাযথভাবেই সেতু নির্মাণ করেছি। সেতু নির্মাণকাজে কোনো অনিয়ম করিনি।’
আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমতলীতে আমার যোগদানের পূর্বে এ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এ সেতু নির্মাণে ঠিকাদারসহ যারা অনিয়ম করেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’