:: ফেনী বুলবুল ::
মানুষের জীবনের কয়েকটি ধাপের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধাপ হল স্কুল জীবন। মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, নৈতিকতা, সামাজিকতা, মানবিকতা, দেশ প্রেম এই সবের ভিত্তি রচিত হয় এই স্কুল জীবনে। একটি মানুষ কতটা উল্লেখিত গুনের, মূ্ল্যবোধের অধিকারী হবে এবং একজন সত্যিকারের মানুষ হবে তার সিংহভাগ নির্ভর করে তার এই স্কুল জীবন কাদের সান্নিধ্যে থাকছে তার উপর। পূর্বচন্দ্রপুর হাই স্কুল তথা সাবেক বৈরাগীর বাজার হাই স্কুলের হাজারো ছাত্রের সৌভাগ্য যে তারা জনাব নুর আহমেদ ছুট্টু, স্বর্গীয় গোপাল চন্দ্র দাস এবং জনাব জাকারিয়া কামালের সান্নিধ্যে কাটিয়েছে তাদের এই স্কুল জীবন।
সকাল বেলায় স্কুলে গিয়ে দেখা যেত সবচেয়ে পরিপাটি লোকটিই জাকারিয়া কামাল। টাই পরা স্মার্ট একজন শিক্ষক। সেই সময়কার রাজধানীর কোন স্কুল ছাত্ররাও টাই পরা এমন স্মার্ট শিক্ষক পেয়েছে কিনা আমার সন্দেহ। আজকে দীর্ঘ সময় পার হয়ে এসে কর্মস্থলে অনেক বড় বড় নির্বাহীকেও দেখি অন্যকে দিয়ে টাই বাধাচ্ছেন, তখন গর্বে আমার বুক ফুলে উঠে কারন এই শ্রদ্ধেয় জাকারিয়া কামালের সৌজন্যে আমি ক্লাস সিক্সেই টাই বাঁধা শিখেছি। স্যার যখন প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে কথা বলতেন আমি অদ্ভুত হয়ে চেয়ে থাকতাম, একটি মানুষ এত সুন্দর করে এত মজা করে ইংরেজী বলেন কি ভাবে ? সামাজিক, রাজনৈতিক এবং কর্মজীবনে অনেক ইংরেজী জানা লোকের সান্নিধ্য পেয়েছি কিন্তু আরেকটি জাকারিয়া কামাল আমি খুঁজে পাইনি।
আমি এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জনাব নুর আহমেদ ছুট্টু মিয়ার সন্তান পরিচয়ে গর্ববোধ করি। ষাটের দশকে গ্র্যাজুয়েশন করা এই লোকটি তাঁর ছাত্রজীবন থেকে মনের মাঝে একটি স্বপ্ন লালন করতেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষে ভাল চাকুরী করবেন,বড় অফিসার হবেন, অনেক টাকা রোজগার করবেন, অনেক ধনী হবেন সেই রকম কোন স্বপ্ন নয় বরং তার স্বপ্ন ছিল নিজ এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। একটি চাকুরীতে ঢুকেও তিনি ছয়মাসের মাথায় নিজের ইচ্ছা পুরনের নিমিত্তে চাকুরী ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। ১৯৬৮ সালের একটি ছালা রুম থেকে আজকের বিশাল স্কুল কমপ্লেক্স। ৪৮বছর আগে জ্বালিয়ে দেয়া মোমবাতিটি আজকে যেন বৈদ্যুতিক বাতিতে রূপান্তরিত, আলোকিত জেনারেশন হতে জেনারেশন। ১৯৬৮ সাল হতে ২০১৪সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে কত প্রতিকুলতার মাঝে চড়াই উৎরাই পার হয়ে তিনি স্কুলটি এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন সেটি এখন ইতিহাস। সেই ইতিহাসে আমি যাব না আমি শুধু এই ইতিহাস রচয়িতার মুখ থেকে শোনা একটি কথা বলব। কথাটি হল আশির দশকের প্রথমদিকে তিনি বলেছিলেন “আমি একটি অমুল্য সম্পদ পেয়েছি”। বন্ধুগণ এই অমুল্য সম্পদ আর কিছু নয় এই অমুল্য সম্পদ আমাদের প্রিয় জনাব Zakaria Kamal (জাকারিয়া কামাল)। জনাব নুর আহমেদ ছুট্টু মিয়ার স্বপ্নকে চুড়ান্ত রূপদানে জনাব জাকারিয়া কামাল ছিলেন অক্সিজেনের মত।
শ্রদ্ধেয় জাকারিয়া কামাল আমার কাছে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মতোই একটি অদ্ভুত চরিত্র। সদ্য পাশকৃত এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুন স্বনামধন্য শিল্পপতির উচ্চ বেতনের চাকুরীর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে জনাব নুর আহমেদ ছু্ট্টু মিয়ার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আমাদের প্রিয় স্কুলে। তখনও বিয়ে সাদী না করা ব্যাচেলর মানুষটি বেশীরভাগ রাতেই আমাদের ঘরে থাকতেন। বেড়ার ঘরে দুই রুম থেকে তাঁরা দুই জন (আব্বা এবং স্যার) স্কুল নিয়ে আলাপ শুরু করতেন, কিন্তু হঠাৎ করেই দেখা যায় আব্বা একাই কথা বলছেন স্যার কোন সাড়া দিচ্ছেন না, আসলে তিনি ততক্ষনে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন।
সকাল বেলায় স্কুলে গিয়ে দেখা যেত সবচেয়ে পরিপাটি লোকটিই জাকারিয়া কামাল। টাই পরা স্মার্ট একজন শিক্ষক। সেই সময়কার রাজধানীর কোন স্কুল ছাত্ররাও টাই পরা এমন স্মার্ট শিক্ষক পেয়েছে কিনা আমার সন্দেহ। আজকে দীর্ঘ সময় পার হয়ে এসে কর্মস্থলে অনেক বড় বড় নির্বাহীকেও দেখি অন্যকে দিয়ে টাই বাধাচ্ছেন, তখন গর্বে আমার বুক ফুলে উঠে কারন এই শ্রদ্ধেয় জাকারিয়া কামালের সৌজন্যে আমি ক্লাস সিক্সেই টাই বাঁধা শিখেছি। স্যার যখন প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে কথা বলতেন আমি অদ্ভুত হয়ে চেয়ে থাকতাম, একটি মানুষ এত সুন্দর করে এত মজা করে ইংরেজী বলেন কি ভাবে ? সামাজিক, রাজনৈতিক এবং কর্মজীবনে অনেক ইংরেজী জানা লোকের সান্নিধ্য পেয়েছি কিন্তু আরেকটি জাকারিয়া কামাল আমি খুঁজে পাইনি। রামনগর কে,এম, সি হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মোয়াজ্জম হোসেন একবার বলেছিলেন, “জাকারিয়া প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পকেটে যত চাপ দেয় ততই ইংরেজী বের হয়”। আমি শুধু এক কথায় বলব স্যার আমার কাছে “Living Thesaurus “. এত মেধা, এত জ্ঞান শুধু পড়াশুনা করে অর্জন করা যায় তা আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় শ্রদ্ধেয় জাকারিয়া কামাল সৃষ্টি কর্তার সৃষ্ট একটি বিস্ময়।
মজা পেতাম লুঙ্গি পরতে অনভ্যস্ত একজন মানুষের অদ্ভুতভাবে লুঙ্গি পরা দেখে, আনাড়ীর মতো হঠাৎ হঠাৎ পান এবং সিগারেট খাওয়া দেখে। বাজারে লুকিয়ে দোকানের পিছনে কেরাম খেলতাম হঠাৎ করে “ভিতরে কে বুলবুল নাকি” বলেই ঢুকে যেতেন কেরাম খেলতে। বিকালে ফুলপ্যান্ট পরে নেমে যেতেন ফুটবল খেলতে, হয়ত সারা খেলায় একবারও বল পেতেন না তবু মাঠে থাকতেন। জনাব জাকারিয়া কামালের সরলতায়, বন্ধু সুলভতায় মুগ্ধ হয়ে যেতাম শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যেত। স্কুলের পাঠ্য পুস্তক নয় শুধু প্রতিটি মুহুর্ত্বেই আমরা শিখতাম জনাব জাকারিয়া কামালের কাছ থেকে। জনাব জাকারিয়া কামালের জ্ঞানের গভীরতা তলদেশবিহীন। তাঁর সততা এবং নিষ্ঠা আগামী সমাজের জন্য হয়ে থাকবে শিক্ষনীয় এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আমাদের ছোট ভাইদের দেয়া চমৎকার বিদায় সংবর্ধনার পর স্যারের পাঠানো মেসেজটি ফেইসবুকের বদৌলতে দেখেছি এবং পড়েছি। অনেকবার পড়েছি অনেকবার কেদেঁছি। আপনার সততা,সরলতা, উদারতা, ভদ্রতাই আমাকে কাদিঁয়েছে।
স্যারের উদ্দেশ্যে শুধু এইটুকু বলতে চাই, “স্যার আপনি শুধু আমার প্রিয় শিক্ষকই নন, তার চেয়েও বেশী কিছু”।
স্যার গোপাল চন্দ্র দাস তার পরিবারকে এমন এক অনিশ্চয়তার মাঝে রেখে অকালে স্বর্গীয় হয়েছেন যে রেখে যেতে পারেননি পরিবারের জন্য নূন্যতম অন্নের নিশ্চয়তাটুকু। শ্রদ্ধেয় জাকারিয়া কামালের সামনেও অবসর জীবন, সন্তানদের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত। অথচ কত শত পরিবারের ভবিষ্যত তারা নিশ্চিত করেছেন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে। শত আর্থিক সংকটে, টানাপোড়নেও তাঁরা শিক্ষকতার মহান পেশাকে বানিজ্যে রুপান্তর করেননি।
এক যুগেরও বেশী সময় ধরে স্কুলে যাইনি, স্কুল মাঠে খেলিনি দুই দশক ধরে । তাই বলে কি একদিনের জন্যও এই মহান ব্যক্তিগণ এবং স্কুলকে ভুলতে পেরেছি! আমিতো এখনও স্বপ্নের মাঝে অংক করি, ইংলিশ গ্রামার পড়ি আর আমার সামনে বসে থাকেন ভাবগম্ভীর স্বর্গীয় গোপাল স্যার। আমি অবচেতন মনে ইংরেজী স্পোকেন চর্চ্চা করি আর আমার সামনে দাড়িয়ে প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে শ্রদ্ধেয় জাকারিয়া স্যার। এখনও আমার শিরদাড়া বয়ে বরফ শীতলতা নেমে যায় যখন মনে হয় আব্বা আমাকে অফিস রুমে ডাকছেন। নিশ্চিত বেত্রাঘাত যতক্ষন পর্যন্ত না কোন স্যার আমাকে উদ্ধার না করেন। এখনও জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি শ্রদ্ধেয় নারায়ন চন্দ্র দাস আবৃতি করছেন গীতি আলেখ্য অনুষ্ঠানে। বাংলা ক্লাসে নেচে নেচে সাহিত্যের রসারহন করছেন। ব্লাক বোর্ডে ছাপা অক্ষরের মত করে বাংলা – ইংরেজি লিখছেন। এখনও আমার বুকের মাঝে দোলা উঠে অমলেন্দু ভট্টাচার্যের তবলার তালে তালে। এখনো আমার মনকে ঝাকিয়ে দেয় নেপালদা, আলাউদ্দিন কাকার জারি গানে, পরেশদার কবর কবিতার আবৃতিতে, মোশারফ ভাইয়ের যেমন খুশি তেমন সাজো সাজে, ছোট্ট সুবর্ণা, প্রকৃতী প্রভা রায় দিদি এবং বীণা পাণি চৌধুরী দিদির সুরেলা গানে।