:: কলকাতা প্রতিনিধি ::
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের লাশ উদ্ধার করেছে ভারতের পুলিশ। বুধবার (২২ মে) সকালে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
চিকিৎসা ও বন্ধুর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে গত ১২ মে ভারতে যান আনার। পরদিন ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। গত ১৬ মে সকাল ৭টা ৪৬ মিনিটে এমপি আনারের ফোন থেকে পিএসের নম্বরে সর্বশেষ কল আসে। কলটি ধরতে পারেননি পিএস। এক মিনিট পর পিএস তাঁকে কল করলে ওপাশ থেকে রিসিভ হয়নি। এর পর থেকে এমপির সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই।
এমপি আনার একা দর্শনা চেকপোস্ট দিয়ে ভারতের গেদে প্রবেশ করেন। এর পর কলকাতার ব্যারাকপুর সংলগ্ন মণ্ডলপাড়ায় পূর্বপরিচিত স্বর্ণ কারবারি গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তিনি। আজীম নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের বরানগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন গোপাল। তাঁর দাবি, ‘১৩ মে চিকিৎসার কথা বলে বাসা থেকে বের হন আজীম। এর পর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের একটি খুদেবার্তায় এমপি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কাজে দিল্লি যাচ্ছি। পৌঁছে ফোন করব, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’ ১৫ মে বেলা ১১টা ২১ মিনিটে আরেকটি মেসেজে জানান, ‘আমি দিল্লি পৌঁছলাম, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছেন। ফোন করার দরকার নেই।’
জানা যায়, এমপি আনার কলকাতার মণ্ডলপাড়ায় তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে উঠেছিলেন। পরদিন দুপুর পৌনে ২টার দিকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য বের হন তিনি। এর পর আর ফিরে আসেননি।
পরে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গোপাল বিশ্বাস।
ভারতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বরানগর থানার অন্তর্গত ১৭/৩ মণ্ডল পাড়া লেনের বাসিন্দা তার দীর্ঘদিনের পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে উঠেন আনার। মূলত ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ওই বন্ধুর বাড়িতে আসেন তিনি। পরদিন ১৩ মে দুপুরে ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় ফেরার কথা থাকলেও তিনি আর ফিরে আসেননি। পরে গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় একটি নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করেন গোপাল বিশ্বাস।
এমপি আজিম নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় ভারতেও নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ বলছেন, তিনি বেঁচে নেই। আবার কারও দাবি, তিনি একটি ক্রুজে রয়েছেন। গোপাল বিশ্বাসের এসআরবি জুয়েলার্স গতকাল বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনি বাড়িতে থাকলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
আনোয়ারুল আজিম ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিন বার আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এক সময় আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ওয়ারেন্টভুক্ত ছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার। আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৬ সালে ইন্টারপোলের তালিকায় তার নাম ওঠে। ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার হওয়ার পর এলাকায় ফিরে আগের মতোই কর্মকাণ্ড শুরু করেন তিনি।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান।
আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার।
১৯৮৬ সালের দিকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে আনার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন তিনি। ওই সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান। ১৯৯১ সালে আনার ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বর্ণের বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাচার করতেন তারা।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন আনোয়ারুল আজিম আনার। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের সঙ্গে কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারে জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো। কথিত আছে, সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ ভারতে আত্মগোপন করার পর তার মাধ্যমে অস্ত্র চোরাকারবার চালিয়ে যান আনার। বাগদা এলাকার মাদক সম্রাট জয়ন্ত কুমার, কার্তিক, গৌতম সাহা ও বনগাঁর দেবদাসের সঙ্গে আনারের মাদকের কারবার ছিল।
২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হয় যে, দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল। তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেফতারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর দশ দিন পর ওই বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার।
কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুলের সঙ্গে দেড় যুগ ধরে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে আনারের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে তার দাপট। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে চরমপন্থি বিরোধী অভিযান শুরু হলে বিদেশে চলে যান এই মুকুল। এরপর দেশের বাইরে বসেই রাজত্ব সামলান তিনি। এলাকার অনেক রাজনৈতিক নেতা ও ঠিকাদার তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। আবার বিদেশে গিয়ে তার সঙ্গে দেখাও করেন। গত সংসদ নির্বাচনের পর কুষ্টিয়ার একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বিদেশে গিয়ে মুকুলের সঙ্গে দেখা করেছেন বলে স্থানীয়ভাবে আলোচনা রয়েছে।
মুকুল বেশিরভাগ সময় ইতালি থাকেন। মাঝেমধ্যে থাইল্যান্ড যান। নেপালে তার ব্যবসা রয়েছে। বেশভূষায় পরিবর্তন এনে তিনি এখন জুব্বা পরেন। বছরচারেক আগেও তিনি মালয়েশিয়ায় থাকতেন। কুষ্টিয়া শহরের গোশালা রোডে তার দুটি আলিশান পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া বটতৈল মোড় ও ভাদালিয়ায় বাড়ি রয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় তার ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় তার কমপক্ষে ১০টি ফ্ল্যাট আছে। কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন ব্যাংকে স্বজনের নামে তিনি টাকা রেখেছেন। দেশের বাইরে বিপুল টাকা পাচার করেছেন। এ ছাড়া মুকুলের নামে বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের একাধিক মামলা রয়েছে।
সূত্র জানায়, মুকুলের উত্থান নব্বইয়ের দশকে। কুষ্টিয়ার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন -এর রাজনীতিতে যুক্ত হন। সে সময় গোপনে চরমপন্থি বাহিনীও গড়ে তোলেন। ’৯০ সালের দিকে মুকুল প্রথম পুলিশের হাতে আটক হন। ছাড়া পেয়ে গা-ঢাকা দেন। পরে কিছুদিন সদর উপজেলার ভাদালিয়া এলাকায় নার্সারির ব্যবসা করলেও কুষ্টিয়া ছেড়ে ঝিনাইদহ চলে যান। শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলনের রাজনীতি ছেড়ে গণমুক্তি ফৌজ নামে চরমপন্থি সংগঠন গঠন করেন। শাহিন ও লিপটন ছিল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীকে হত্যা করে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে এই বাহিনী। চরমপন্থি মুকুল বাহিনীর সদস্যরা ওই সময় বিএনপি নেতা ভিসি শহীদ ও বাচ্চু, ঠিকাদার জামু ও হাবিব, কুষ্টিয়ার থানাপাড়ার বাবু, কয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জামিল হোসেন বাচ্চু, ব্যবসায়ী বকুল সওদাগরসহ প্রায় এক ডজন হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এমনকি টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিতে সড়ক ও জনপথ অফিসের সামনে তিনজনের বিচ্ছিন্ন মস্তক এবং জি কে অফিসের সামনে দুজনের কাটা মাথা রেখে আতঙ্ক ছড়ান মুকুল। এসব হত্যাকাণ্ডের পর দায় স্বীকার করে মিডিয়ায় বিবৃতিও দিতেন মুকুল।