রেমাল: মোংলা ও পায়রায় ৭ নম্বর বিপদ সংকেত

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে দেশের চারটি সমুদ্র বন্দরের ওপর সতর্ক সংকেত বাড়ানো হয়েছে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

শনিবার (২৫ মে) রাতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (বিডব্লিউওটি) জানায়, বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করা গভীর নিম্নচাপটি সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে ঘূর্ণিঝড় রেমালে পরিণত হয়েছে। যা সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি-১ শক্তিমাত্রার ঝড় হিসেবে ২৬ মে দিবাগত রাত থেকে ২৭ মে সকালের মধ্যে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান রাত ৯টার দিকে জানান, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় মাছ ধরা সব নৌকা ও ট্রলারকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসতে বলা হয়েছে। রাতেই ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও ভারতের ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি বয়ে যাবে। এ সময় বাতাসের গতি ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাবে, যা প্রচণ্ড দমকা ও ঝড়ো হওয়া হিসাবে ১২০ থেকে ১৩০ মিলোমিটার বেগে বয়ে যেতে পারে। ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে। চট্টগ্রাম ও বরিশালে বেশি বৃষ্টিপাত হবে। ফলে চট্টগ্রামে ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দীঘা থেকে বাংলাদেশের পটুয়াখালীর মাঝামাঝি যে কোনো জায়গা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। পটুয়াখালী ছাড়াও সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট। বিডব্লিউওটি’র বার্তায় বলা হয়, এ ঘূর্ণিঝড়ের সর্বোচ্চ শক্তিমাত্রা হতে পারে ক্যাটাগরি-১।

এদিকে শনিবার সচিবালয়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে শনিবার রাত থেকেই মহাবিপদ (১০ নম্বর) সংকেত দেখানো হতে পারে। 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা বুঝতে পেরেছি ঘূর্ণিঝড়টি আসন্ন। রাত ১২টা-১টা নাগাদ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি হতে পারে। এমন একটা সম্ভাবনা রয়েছে। 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, পূর্বাভাস পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে রোববার সন্ধ্যা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি মূল আঘাত হানবে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি হিসাবে এরই মধ্যে ৪ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমাদের প্রতিটি জেলার গুদামে পর্যাপ্ত শুকনো খাবারসহ যেসব জিনিস দরকার হবে, এগুলো মজুত রেখেছি। অতিরিক্ত প্রয়োজন হলে যেন ঢাকা থেকে সরবরাহ করা যায়, সেই প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে। 

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্তমানে যে অবস্থান দেখাচ্ছে তাতে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের ওপর দিয়েই অতিক্রম করার আশঙ্কা আছে। তবে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা এবং বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা জেলায় রেমালের আঘাত হানার আশঙ্কা বেশি বলে জানান আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক। 

তিনি জানান, প্রবল ঘূর্ণিঝড় হলে ৩ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এদিকে সাগরে নিম্নচাপ থাকলেও সারা দেশে মৃদু ও মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহ শনিবারও অব্যাহত ছিল। রাজধানী ঢাকাসহ রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। প্রচণ্ড গরমে জনজীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা। তবে রেমালের প্রভাবে সারা দেশে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় উপকূলীয় অঞ্চলে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বিআইডব্লিওটিএ। 

সাতক্ষীরায় প্রস্তুত ১৮৭ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র

সাতক্ষীরায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ১৮৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। পাশাপাশি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, ওষুধ ও সুপেয় পানি। প্রস্তুত রয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা। বরগুনায় জোয়ারে নদনদীর পানির উচ্চতা তিন ফুট বেড়েছে। এ জেলায় ৭৬৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে প্রশাসন। খুলনার কয়রায় ১১৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উপজেলার সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

এর আগে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করছে এবং শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টার মধ্যে যে কোনো সময় ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। তিনি বলেন, যদি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়, তাহলে রোববার (আজ) বেলা ৩টা থেকেই এর প্রভাব শুরু হতে পারে। পরবর্তী সময়ে সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টার মধ্যে যে কোনো সময় এটি উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, রেমাল একটি ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ হতে পারে। সেক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়টি সর্বপ্রথম যেখানে আঘাত হানবে, সেখানের বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রেমালের গতিবেগ নিয়ে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, সিডরের মতো অত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় নয় এটি, সিডরের থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। 

এদিকে তাপপ্রবাহ থাকলেও সারা দেশে বৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। চট্টগ্রাম ও বরিশালে শনিবার বৃষ্টিপাত হয়েছে। নিম্নচাপের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি হতে পারে। 

চট্টগ্রাম বন্দরে লাইটার জাহাজ চলাচল বন্ধ

সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় রেমাল -এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। শনিবার বিকালে আবহাওয়া অধিদপ্তর চট্টগ্রামসহ দেশের চার সমুদ্রবন্দরের জন্য তিন নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে নির্দেশনা দেওয়ার পর লাইটার জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে লাইটার জাহাজ ব্যবহার হয়। দুপুর পর্যন্ত বহির্নোঙর ও জেটিতে পণ্য খালাস স্বাভাবিক ছিল। তবে এরপর বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া শুরু হলে পণ্য ওঠানামা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসাবে সকালে বন্দর ভবনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলের সভাপতিত্বে এতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় আবহাওয়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে যখন যে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন হবে, এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। 

মোংলা বন্দরের ব্যাপক প্রস্তুতি

সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবিলায় মোংলা বন্দরের সভাকক্ষে শনিবার বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমানের সভাপতিত্বে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস (ইপিজেড), এনএসআই, ডিজিএফআই প্রতিনিধিসহ মোংলা বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি ও জুমের মাধ্যমে অংশ নেন। গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সব কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মস্থলে অবস্থান করবেন। ৪নং সতর্কতা সংকেতের পর থেকে বন্দরের সব অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। কোস্ট গার্ড মাইকিং করে মানুষজনকে সতর্ক করছে এবং সময়মতো আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বলেছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *