৯ দিন পর সেন্টমার্টিনে পণ্যবাহী জাহাজ

:: টেকনাফ প্রতিনিধি ::

মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের দিকে গুলি চালানোর সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ ৯ দিন বন্ধ ছিল। শুক্রবার রাত ১টায় বিকল্প রুটে বঙ্গোপসাগর হয়ে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বহনকারী জাহাজ সেন্টমার্টিনে পৌঁছে।

সংকটে পড়া দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্য কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে আতঙ্ক কাটেনি। কেননা এখনও টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুট চলাচল বন্ধ। ফলে দ্বীপের মুমূর্ষু রোগীসহ সাধারণ মানুষ বিপাকে রয়েছেন।

শুক্রবার রাতে চাল, ডাল, তেল, পানি, পেঁয়াজসহ নানা ভোগ্যপণ্য নিয়ে একটি জাহাজ সেন্টমার্টিনে পৌঁছেছে। জাহাজে করে কক্সবাজারে আটকা থাকা অনেকে ফিরেছেন দ্বীপে। শনিবার সকালে জাহাজটি ফিরে যায়। 

সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিত্যপণ্য আসায় আগের তুলনায় খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে চলাচল স্বাভাবিক না হলে ফের সংকট তৈরি হতে পারে বলে শঙ্কা তাদের। 

গত বৃহস্পতিবার হার্ট অ্যাটাক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন সেন্টমার্টিনের বিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নৈশ প্রহরী মুজিবুর রহমান (২৪)। কক্সবাজারে আসতে না পারায় তিনি দ্বীপেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এ রকম বেশ কয়েকজন রোগী রয়েছে যারা চিকিৎসা সংকটে ভুগছেন।

মুজিবুর রহমানের মা এলাম বাহার বলেন, দ্বীপের হাসপাতালে চিকিৎসক মুজিবুরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজারে নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু কোনো স্পিডবোট বা ট্রলার না ছাড়ায় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি।   

সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, দ্বীপে জাহাজ আসার পর থেকে অনেকটা স্বস্তিতে রয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে মিয়ানমার সীমান্তে জাহাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মাঝে প্রশ্ন জাগছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, খাদ্য ছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে ভিজিডিসহ জেলেদের জন্য সহায়তা এসেছে। সেগুলো আমরা বিতরণ করছি। জেলা প্রশাসনের পাঠানো পাঁচটি কোরবানির পশুর মাংস বাসিন্দাদের বিতরণ করা হবে।

তিনি জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপের পূর্বে মিয়ানমার জলসীমানায় ৫-৬টি জাহাজ দেখা যাচ্ছে। তবে আমাদের জলসীমানায় কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর জাহাজ টহলে থাকায় আতঙ্ক নেই।
 
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা -ইউএনও মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুট স্বাভাবিক করতে কাজ করছি আমরা।

গত ৫ জুন থেকে টানা কয়েকবার থেকে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের দিকে গুলি চালানোর ঘটনায় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। 

গত ১ জুন বিকেল সাড়ে ৩টায় টেকনাফ পৌরসভার নৌকা ঘাট থেকে ১টি ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে মুদি মালামাল ও ১০ জন যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নাইক্ষ্যদিয়া খাল এলাকা অতিক্রমের সময় আরাকান আর্মি ট্রলারকে লক্ষ্য করে ৬-৭ রাউন্ড ভারী অস্ত্র ফায়ার করা হয়। ঐ ফায়ারের ফলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবং ট্রলারটি বিকাল ৫টা ৫৫ মিনিটে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছে।

গত ৫ জুন সেন্টমার্টিনের জিনজিরায় স্থগিতকৃত একটি কেন্দ্রে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের ফলাফল নির্ধারণের জন্য ভোট গ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট শাফকাত আলীর নেতৃত্বে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ২৭ জন সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফের উদ্দেশে মেটাল শার্ক ও কাঠের বোটযোগে টেকনাফে ফিরছিলেন। পথে নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নাইক্ষ্যংদিয়া চর এলাকা অতিক্রম করার সময় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং এলাকা থেকে মেটাল শার্ক ও কাঠের বোটকে লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি গুলিবর্ষণ করলে মেটাল শার্কে ২ রাউন্ড এবং কাঠের বোর্ডে ৪ রাউন্ড গুলি লাগে। পরবর্তীতে ঐ বোট এবং মেটাল শার্ক দুটি নিরাপদে টেকনাফ কোস্টগার্ডের বোটপুলে ফিরে আসে।

গত ৮ জুন ১২টার দিকে নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদীর মোহনায় ২টি কাঠের ট্রলার, টেকনাফ পৌরসভাস্থ কাউকখালী ঘাট থেকে সিমেন্ট, রড ও ৬ জন যাত্রী নিয়ে নৌকাযোগে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাওয়ার পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার থেকে আরাকান আর্মি কর্তৃক আনুমানিক ১৫-২০ রাউন্ড গুলি করা হয়। পরে ট্রলার দুটি ১২টা ২৫ মিনিটের দিকে শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে ফিরে আসে। এতে ১টি ট্রলারে ৭ রাউন্ড গুলি আঘাত হানে। এ ঘটনায়ও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

১১ জুন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের গোলারচরের বিপরীতে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদীর মোহনা হয়ে একটি স্পিডবোটযোগে সেন্টমার্টিনের ৫ জন স্থানীয় বাঙালি শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে সেন্টমার্টিনে গমন করছিল। পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং বিজিপি ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার এলাকা থেকে আরাকান আর্মি বর্ণিত স্পিডবোটকে লক্ষ্য আনুমানিক ৪-৫ রাউন্ড গুলি করে। এতে স্পিডবোটে অবস্থানরত বাঙালিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যদিও কেউ হতাহত হয়নি। পরবর্তীতে ১১টার দিকে স্পিডবোটটি সেন্টমার্টিনে পৌঁছায়।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে ৮ হাজার ৪৯২ জন বাসিন্দা বসবাস করে। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা না গেলে এই দ্বীপের বাসিন্দারা খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। কারণ, সেন্টমার্টিনের সাধারণ জনগণ মূলত টেকনাফ থেকে খাদ্যপণ্য নিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে জীবন-যাপন করে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে গত ১৩ জুন থেকে কক্সবাজার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে বড় বড় ট্রলারে সেন্টমার্টিনে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা হচ্ছে। 

বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা রোধকল্পে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সাধন করা যেতে পারে। 

এছাড়াও সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য টেকনাফের সাবরাং টুরিজ্যম ইকো পার্ক সংলগ্ন সাগর উপকূলে একটি জেটি ঘাট নির্মাণ করা যেতে পারে। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *