:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
ঈদুল আজহার আগে ও পরে ১৩ দিনে দেশে ২৫১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬২ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৫৪৩ জন।
সোমবার (২৪ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঈদুল আজহা উদযাপনকালে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
প্রতিষ্ঠানটি ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজপোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১১ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত এই ১৩ দিনে দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ৩২ জন নারী ও ৪৪টি শিশু রয়েছে।
- ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ১৩.৩১ শতাংশ
- দুর্ঘটনায় ৯৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকার মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে
১২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১০৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৯.৬৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৫১.৩৯ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৪৯ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ১৮.৭০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ২৮ জন, অর্থাৎ ১০.৬৮ শতাংশ।
এই সময়ে ৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ৩ জন আহত হয়েছে। ১৬টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ৮ জন আহত হয়েছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১০৪ জন (৩৯.৬৯%), বাস যাত্রী ১১ জন (৪.১৯%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ১৫ জন (৫.৭২%), প্রাইভেটকার- মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ২৪ জন (৯.১৬%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান- লেগুনা-টেম্পু) ৪৫ জন (১৭.১৭%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-ভটভটি-পাওয়ারটিলার) ৯জন (৩.৪৩%) এবং বাইসাইকেল আরোহী ৫ জন (১.৯০%) নিহত হয়েছে।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯৭টি (৩৮.৬৪%) জাতীয় মহাসড়কে, ৯১টি (৩৬.২৫%) আঞ্চলিক সড়কে, ২৮টি (১১.১৫%) গ্রামীণ সড়কে, ৩২টি (১২.৭৪%) শহরের সড়কে এবং ৩টি (১.১৯%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন:
দুর্ঘটনাসমূহের ৬৪টি (২৫.৪৯%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১০৩টি (৪১.০৩%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৪৯টি (১৯.৫২%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ২৭টি (১০.৭৫%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৮টি (৩.১৮%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ড্রামট্রাক-ট্রলি-কার্গো ট্রাক-ট্যাঙ্ক-লরি ১৮.৫৭%, যাত্রীবাহী বাস ১৩.৩২%, প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স-জীপ ৭.৩১%, মোটরসাইকেল ২৫.৮৯%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু) ১৯.৮৮%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-করিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-ঢালাই মেশিন গাড়ি-পাওয়ারটিলার) ৮.০৬%, বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা ৩.৫৬% এবং অজ্ঞাত গাড়ি ৩.৩৭%।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৩৩টি। (বাস ৭১, ট্রাক ৫২, কাভার্ডভ্যান ১০, পিকআপ ১৩, ট্রাক্টর ৮, ড্রামট্রাক ৯, ট্রলি ৩, কার্গো ট্রাক ২, ট্যাঙ্ক লরি ২, মাইক্রোবাস ১৬, প্রাইভেটকার ১৮, অ্যাম্বুলেন্স ২, জীপ ৩, মোটরসাইকেল ১৩৮, থ্রি-হুইলার ১০৬ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪৩ (নসিমন-করিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-ঢালাই মেশিন গাড়ি-পাওয়ারটিলার), বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা ১৯ এবং অজ্ঞাত গাড়ি ১৮টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৬.৩৭%, সকালে ২৩.১০%, দুপুরে ২৭.৪৯%, বিকালে ১৭.১৩%, সন্ধ্যায় ৫.৫৭% এবং রাতে ২০.৩১%।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ:
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০.৯০%, মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২৭.২৭% এবং অন্য যানবাহন দ্বারা মোটরসাইকেলে চাপা/ধাক্কায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩১.৮১%।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২৮.৩৫ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর। ৪৭.৭৬ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর এবং ২৩.৮৮ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৬০ বছর।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৮.৬৮%, প্রাণহানি ২৫.৫৭%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.১৩%, প্রাণহানি ১২.৯৭%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৭.৯২%, প্রাণহানি ১৪.৮৮%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১১.১৫%, প্রাণহানি ১৩.৩৫%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.১৬%, প্রাণহানি ১৩.৭৪%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৩.১৮%, প্রাণহানি ২.৬৭%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৭৭%, প্রাণহানি ৯.৯২% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৯৬%, প্রাণহানি ৬.৮৭% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৭২টি দুর্ঘটনায় ৬৭ জন নিহত হয়েছে। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৮টি দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছে। একক জেলা হিসেবে দিনাজপুরে সবচেয়ে বেশি ১৬ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম শরীয়তপুর, রাঙামাটি, সুনামগঞ্জ, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রাম জেলায়। এই ৫টি জেলায় স্বল্প মাত্রার কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।
রাজধানী ঢাকায় ১৮টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছে।
ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনা:
ঈদুল আজহা উদযাপনকালে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ৯ শত ৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সেজন্য এই হিসাবের সাথে আরও ৩০% যোগ করতে হবে। iRAP (International Road Assessment Porgram) এর Method অনুযায়ী হিসাবটি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ যানবাহন বা প্রপার্টি ড্যামেজ হয়েছে তার তথ্য না পাওয়ার কারণে প্রপার্টি ড্যামেজের আর্থিক পরিমাপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
ঈদ উদযাপনকালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২০.১৫ জন নিহত হয়েছে। গত বছরের ঈদুল আজহায় প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ২১.৬ জন। এই হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবছর প্রাণহানি কমেছে ৬.৭১ শতাংশ। তবে এটা কোনো টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না। কারণ সড়ক পরিবহন খাতে ব্যবস্থাপনাগত কোনো উন্নতি হয়নি।
গত বছরের ঈদুল আজহা উদযাপনকালের তুলনায় এবছর বাইক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ১৩.৩১ শতাংশ।
ঈদযাত্রায় মহাসড়কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ভালো ছিল। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবং বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান দুর্ঘটনা কমানোর জন্য আন্তরিকভাবে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। যদিও স্টেকহোল্ডারদের অসহযোগিতার কারণে এসব উদ্যোগের পুরোটা বাস্তবায়ন হয়নি, বিধায় প্রত্যাশিত ফলাফল আসেনি।
ঈদযাত্রায় রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করেছেন এবং প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ আন্তঃজেলায় যাতায়াত করেছেন। উত্তর বঙ্গগামী সড়কের চন্দ্রা ও টাঙ্গাইলে যানজট হয়েছে। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও যানজট হয়েছে, তবে অসহনীয় মাত্রায় হয়নি। অনেক পরিবহন মালিক যাত্রীদের নিকট হতে বেশি ভাড়া আদায় করেছে। বিআরটিএ এই ভাড়া নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ট্রেনে কিছুটা শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। টিকেট কালোবাজারী হয়েছে। নৌ-পথে স্বস্তি থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে। ঈদের ফিরতি যাত্রায় বাসে, লঞ্চে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ঈদ উদযাপনকালে যে সকল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেনি, শুধু আহত হয়েছে- সেসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই গণমাধ্যমে আসেনি। ফলে দুর্ঘটনায় আহতের প্রকৃত চিত্র জানা যায়নি।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:
১.ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ:
১.দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে; ৮. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৯. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ১০. গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটসাইকেল ব্যবহার নিরৎসাহিত করতে হবে; ১১. ঈদের আগে-পরে সড়ক, নৌ ও রেলপথে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে; ১২. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১৩.“সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সড়ক পরিবহন খাতের স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গৃহীত উদ্যোগসমূহ বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে সড়ক পরিবহন আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অতীব জরুরি।