:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
দীর্ঘ ১৪ বছর পর ব্রিটেনের শাসনক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে লেবার পার্টি। লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা দ্বিতীয় চার্লস। শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা গেলে তিনি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন।
বিবিসির দেওয়া তথ্যানুসারে, ৬৫০ আসনের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টি এখন পর্যন্ত ৪১২টি আসন পেয়েছে। বিপরীতে এখনো ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে মাত্র ১২১টি।
বিবিসি, আইটিভি ও স্কাই নিউজের বুথ ফেরত কয়েক ঘণ্টা আগে নির্বাচনে কোন দল কতটি আসন পাবে তার পূর্বাভাস দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, লেবার পার্টি ৪১০টি আসনে নিরঙ্কুশ জয় পাবে ও কনজারভেটিভরা এবারের নির্বাচনে মাত্র ১৪৪টি আসন পাবে। ভোট গণনা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু তাদের লেবার পার্টির নিরঙ্কুশ জয়লাভের পূর্বাভাসটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পরিবর্তনের কাজ শিগগিরই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার। তবে তিনি এটিও স্বীকার করেছেন যে, এই পরিবর্তনের কাজ এতটা সহজও হবে না। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে বাড়ির প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেন এবং স্কুলের গুরুত্বের কথা বলেন। স্টারমার তার বক্তব্যে “একটি অনিরাপদ বিশ্বের চ্যালেঞ্জ” তুলে ধরে তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতির কথা জানান। এ সময় তিনি প্রথম ব্রিটিশ এশিয়ান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পূর্বসূরি ঋষি সুনাকের কাজকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এদিকে ফলাফল আসার আগেই স্যার কিয়ার স্টারমারকে ফোন করে নির্বাচনে তার জয়ের জন্য অভিনন্দনও জানিয়েছেন ঋষি সুনাক। তার পরাজয় মেনে নিয়ে রিচমন্ড ও নর্দার্ন অ্যালার্টনে সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমি দুঃখিত। পরাজয়ের দায় আমার।’
এখনো অবশ্য ২টি আসনের ফলাফল ঘোষণা বাকি। তবে তা লেবার পার্টিকে ক্ষমতার থেকে দূরে রাখার জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। কারণ সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় ৩২৬ আসনের চেয়ে লেবার পার্টি প্রায় ৯০টি আসন বেশি পেয়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি বাজে ফল করার পর দলটির নেতা নির্বাচিত হন কিয়ার স্টারমার। তাঁর আগে অবশ্য তিনি আইন পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
শূন্য থেকেই উঠে আসা একজন কিয়ার স্টারমার
কিয়ার স্টারমারের বর্তমান বয়স ৬১ বছর। তিনি লন্ডনের উপকণ্ঠে অবস্থিত সারে শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কাজ করেছেন। আর বাবা পেশায় ছিলেন টুলমেকার বা যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক। তাঁর মা আজীবন বাতের অসুস্থতায় ভুগেছেন। বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না।
কিয়ার স্টারমার একপ্রকার শূন্য থেকেই উঠে আসা। তিনিই তাঁর পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রেখেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিয়ার স্টারমার বাম ঘরানার একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্রিটেনের লিডস ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরুর আগে তিনি রিগেট গ্রামার স্কুলে এবং পরে অক্সফোর্ডের সেন্ট এডমন্ড হলে পড়াশোনা করেন।
পরে তিনি একজন ব্যারিস্টার হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। দ্রুতই তিনি নিজেকে মানবাধিকার সংক্রান্ত আইনের ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আইন বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞা ও নিষ্ঠা তাঁকে ২০০৮ সালে ব্রিটেনের পাবলিক প্রসিকিউশন বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এই পদে তিনি ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর পরের বছর ব্রিটিশ রাজ পরিবারের তরফ থেকে তাঁকে নাইটহুড তথা স্যার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপরই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন।
কিয়ার স্টারমার পরে ২০১৫ সালে লেবার পার্টি থেকে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। তাঁর নির্বাচন জয়ের কয়েক সপ্তাহের মাথায় মা মারা যান। তাঁর বাবাও মারা যান বছর তিনেক পর। কিয়ার স্টারমার বাবার মৃত্যুর পর একাধিকবার আক্ষেপ করেছেন যে, তিনি তাঁর বাবাকে একবারও বলতে পারেননি যে, তিনি তাঁকে ভালোবাসেন।
২০১৫ সালের পর রাজনীতিতে কিয়ার স্টারমারকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৯ সালে লেবার পার্টির নির্বাচনে ভরাডুবির পর তাঁকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। যদিও অনেকেই সমালোচনা করে বলেন, কিয়ার স্টারমারের মাঝে কোনো রাজনৈতিক ক্যারিশমা নেই। তারপরও তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি লেবার পার্টিকে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলে ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছেন।
আইন বিষয়ে দারুণ প্রাজ্ঞ হওয়ার পরও কিয়ার স্টারমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি খুবই বিরক্তিকর একজন রাজনীতিবিদ। তাঁর কোনো ক্যারিশমা নেই। কিন্তু এসব সমালোচনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে খুব এক প্রভাব ফেলেনি। বরং তিনি আরও বেশি করে সেদিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
এ বিষয়ে একবার ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যম আইটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিয়ার স্টারমার বলেছিলেন, ‘যদি এমনটা কেউ বলে থাকে, তবে তা আসলে আমার চরিত্রের দিকে সামান্য কাঁদা ছুড়ে মারা এবং আমি এই বিষয়টির সঙ্গে খুবই পরিচিত।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, কেউ যদি আপনাকে বলে যে—আপনি বিরক্তি কর, তাহলে এটি মাথা রাখবেন যে, আপনিই আসলে জিততে যাচ্ছেন।
কিয়ার স্টারমার হয়তো তাঁর জায়গায় অটল ছিলেন বলেই সামান্য যন্ত্র প্রস্তুতকারীর ছেলে থেকে নাইটহুড উপাধি হাসিল করে আজ ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে চলেছেন। হয়তো তাঁর বিরক্তিকর রাজনৈতিক চরিত্রই তাঁকে জিততে সহায়তা করেছে; যেমনটা তিনি দাবি করেছিলেন।
আগামী ৯ জুলাই নতুন পার্লামেন্ট সদস্যদের শপথগ্রহণ ও স্পিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ১৭ জুলাই রাজা তৃতীয় চার্লসের উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে নতুন সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে।