:: সাইফুল ইসলাম ::
হরিপদ কাপালীকে কেউ কি মনে রেখেছে?
১৯৯১ সালের একটি ভোর। বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের জিলা ঝিনাইদহের, সদর উপজিলার, একটি গ্রাম─ আসাননগর। ৬৯ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, তাঁর দুই বিঘা ইরিধানের জমিটায় জন্মানো─ একগোছা অদ্ভুত ধানগাছের দিকে। এটি তাঁর জমি। বৃদ্ধটি, চাষি। বাংলাদেশের দরিদ্র চাষি। এবং, তিনি, অক্ষরজ্ঞানহীন। কখনোই পাঠশালায় যাননি। ধানের গোছাটির ডগায় আঙুল ছোঁয়ালেন চাষি। তাঁর চোখেমুখে বিস্ময়! কী এটি? এটি ধানগাছ। কিন্তু, তাঁর পুরো জমির, আশেপাশের সমস্ত জমির, কোথাও, এই ধানগাছটি দেখেননি আজন্ম ধানচাষি তিনি! তিনি জানেন না─ এই ধান শুধু ওই গ্রামে নয়, এমনকি বাংলাদেশের কোনো জমিতেই, পৃথিবীরই কোথাও, এই ধানটি আজও জন্মেনি। বিলিয়ন বছরের এই পৃথিবীর বুকে, বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র জমিতে, এই প্রথম নতুন একটি ধানচারা জন্মালো! পৃথিবীর উদ্ভিদের নতুনতম একটি প্রজাতির সর্বপ্রথম উন্মেষ এই বিলিয়ন বছর বুড়ো মাটির বুক চিরে।
“ডারউইনের ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ তত্ত্বটি আমরা সকলেই জানি কম-বেশি। এই ধানের জন্মটি এই তত্ত্বেরই একটি উদাহরণ। বিশেষ কোনো পরিচর্যা ছাড়াই, জীবের বিশেষ কিছু প্রজাতির মধ্যে, পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাবে, প্রায়ই ছোটছোট অভিযোজন ঘটতে থাকে। এই ধানের চারাটির ক্ষেত্রেও এটিই ঘটেছে। এটি অভিযোজিত সর্বপ্রথম একটি ধান-প্রজাতি। ইরি ধানের কয়েকটি প্রজাতির অভিযোজনের ফলেই এই নতুন ধান-প্রজাতিটির সৃষ্টি হলো। তবে, খালিচোখে দেখেই একে আলাদা হিসেবে চিনতে পারা, এবং এই নতুন চারা থেকে বীজ সংগ্রহ করে একে আলাদাভাবে বপন করে এর বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া─ এ সম্পূর্ণ কঠিন কাজ, এবং বিজ্ঞানভিত্তিক একটি প্রক্রিয়া। সেদিক থেকে আমি বলবো─ এই প্রজাতিটির উদ্ভাবনের লক্ষ্যে তাঁর ইচ্ছে, আগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পর্যবেক্ষণশক্তি একজন শিক্ষিত বিজ্ঞানীর মতোই কাজ করেছে, এ অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। নতুন ধানের ব্রিডিং করার জন্য একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে একটি পদ্ধতি হচ্ছে এই ‘সিলেকশন ব্রিডিং’। হরিপদবাবু এই পদ্ধতিতেই এই নতুন জাতের ধানটি আবিষ্কার করেছেন।”─ বলছিলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ ধান্য গবেষণা কেন্দ্র’-এর মৃত্তিকা বিজ্ঞানী কৌশিক মজুমদার।
হ্যাঁ, আমরা, আমাদের গৌরব, চাষি, জনাব হরিপদ কাপালী’র কথা বলছিলাম এতোক্ষণ। ১৯২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ঝিনাইদহের এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া এই দরিদ্র কৃষক, ১৯৯১ সালের সেই ভোরে, তাঁর জমিতে ফলন হওয়া ইরিধানের জমিতে ধানগুলো কাটতে গিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির একটি ধানচারা, দীর্ঘকাল থেকে ধানচাষের অভিজ্ঞতা থেকেই, আলাদা করে শনাক্ত করেছিলেন, খালিচোখেই। এরপর, একই জমিতে, খুঁজতে-খুঁজতে তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন এই নতুন প্রজাতিটির আরও কয়েকটি চারা। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া সম্পূর্ণ নতুন এক প্রাণ! ব্যতিক্রমী সেই ধানগাছের শীষে ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে ধান; ধানগাছগুলোর গড়ন ছিল অন্যান্য ধানগাছের তুলনায় খানিক দীর্ঘ ও শক্ত; এবং ধানগুলো─ বেশ পুরু ও মোটা।
এরপর তিনি কী করলেন? ব্যতিক্রমী চারাগুলোকে একেএকে আলাদা করে তুলে নিলেন তিনি। সংগ্রহ করলেন ধানগুলি। এগুলিকে বীজে পরিণত করে, পরের মৌসুমেই, ১৯৯২ সালে, সেই জমিতেই আলাদা একটি অংশে বপন করলেন বীজগুলো। দেখা যাক, কী হয়? আহ্! সেই পুরো ধানক্ষেত রূপান্তরিত হয়ে গেলো সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজাতির ধানক্ষেতে! সেই ধানগুলো ঘরে তুললেন তিনি, তারপর হিসেব করে দেখলেন─ প্রতি বিঘায় এই ধানের ফলন হয়েছে ২২ মণের বেশি; যেখানে তাঁর চাষ করা আগের উচ্চফলনশীল বিআর-১১ বা স্বর্ণা’র ফলন প্রতি বিঘায় ১৮ মণের কাছাকাছি! তিনি এও লক্ষ্য করলেন─ এই নতুন ধানটির পানি-সহনশীলতাও তুলনামূলকভাবে বেশি, অর্থাৎ─ কাণ্ড মোটা হওয়ায় এর জলে পচে যাওয়ার হার খুব কম; এবং, এই ধানে পোকার আক্রমণও হয়নি তেমন; আর, তিনি দেখলেন─ এই ধান ফলাতে তাঁর সারের প্রয়োজন হয়েছে, বলতে গেলে, খুবই তুচ্ছ পরিমাণের!
না, বাংলার কৃষক হরিপদ চিৎকার করে ওঠেননি “ইউরেকা! ইউরেকা!”… তিনি বলে ওঠেননি “পাইলাম! আমি তাহারে পাইলাম!”… কেবল, একটুকরো অমল হাসি উপচে নেমে এসেছিলো তাঁর ঠোঁটের কোণা বেয়ে! চোখ দু’টিতে কি টলমল অশ্রু ছিল তাঁর? হয়তোবা। বাংলার দরিদ্র চাষিদের জন্য এ তিনি কী উদ্ভাবন করে ফেললেন! অশ্রু তো সুখেরই নিদর্শন প্রায়ই, বুকভরা সুখেরই। তিনি ওইমুহূর্তে ভেবে আকুল হয়েছিলেন; তাঁর দুখী মাতৃভূমির দুখী কৃষকদের সুখের কথা, মুখের হাসির, ভাবনা। ঠিক এই কারণেই, পৃথিবীর পূর্ববর্তী প্রত্যেকটি উদ্ভাবনের পথে তিনি হাঁটলেন না; গেলেন না নিজের নামে এই ধানের প্যাটেন্ট করে, এর কৃতিত্ব নিয়ে, নামী, দামী ও ধনী হওয়ার পথে। পাড়ার, এবং গ্রামের সমস্ত কৃষককে মুহূর্তেই এই ধানগুলো বিলিয়ে দিলেন তিনি তাদের জমিগুলোয় বপন করার জন্য পরবর্তী মৌসুম থেকে! অতঃপর, ১৯৯৪ সালে এসে, দেখা গেলো─ ঝিনাইদহ তো বটেই, বাংলাদেশের পুরো পশ্চিমাঞ্চলের ধানক্ষেতগুলো জ্বলজ্বল করছে নতুন এক ধানজাতের সোনালি আভায়! কৃষকের ঘরেঘরে আরম্ভ হয়েছে অধিক ফলনে প্রাপ্ত অধিক মুনাফার অশ্রু-দরদর সুখের উৎসব! এবং, ঝিনাইদহের চাষিরা, এই ধানের নাম রাখলেন, তাদের মুক্তিদাতা নির্লোভ বান্ধব হরিপদ কাপালীর নামে─ ‘হরিধান’। এই সেই বিখ্যাত হরিধান!
এই সংবাদ দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়লো বাংলাদেশের সমস্ত কৃষকের কাছে, গণমাধ্যমের বদৌলতে! নড়েচড়ে বসলেন ধান-গবেষকরা। স্বাভাবিকভাবেই, প্রথমদিকে, কৃষি অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তা, এই উদ্ভাবনের কৃতিত্ব জনাব হরিপদ কাপালীকে না-দেওয়ার ঈর্ষাগত উদ্দেশ্যে, বলেছিলেন, এই ধান নতুন কোনো প্রজাতি নয়, এটি স্বর্ণা বা বিআর-১১-ই, পরীক্ষানিরীক্ষা না-করেই। কিন্তু, এই ধান যখন বিদেশের ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো পরীক্ষানিরীক্ষা করে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে, এবং যখন বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে হইহই করে লিখালিখি আরম্ভ হলো এ-নিয়ে, টনক নড়লো সেই অন্যায়কারীদের─ ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট’ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো এই ধান। ব্যাস, বদলে গেলো পৃথিবীর ধানের ইতিহাস!
বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে, এই ধান-প্রজাতিটির উদ্ভাবনের স্বীকৃতি দিলো, কৃষক জনাব হরিপদ কাপালীকে, এর নাম স্বীকৃত হলো─ ‘হরিধান’ নামেই। তখন, ১৯৯৬ সাল।
আজ, পেরিয়ে গেছে আড়াই দশকের বেশি। সেদিনের পর থেকে, পৃথিবীতে উদ্ভাবিত হয়ে গেছে আরও একাধিক নতুন প্রজাতির ধান। কিন্তু, আজও, বাংলাদেশের, এবং পৃথিবীর, প্রচুর এলাকায়, হরিধানের চাষ সমান জনপ্রিয় ও প্রচলিত। এর প্রধান কারণ─ ধানটির উৎপাদন-খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম, এবং এটি পোকামাকড়, ক্ষরা ও অতিবৃষ্টি সহিষ্ণু।
ছবির মানুষটিকে চেনেন আপনি? এতে অপরাধ নেই, চকচকে হিপোক্রিট বিখ্যাতদেরকে চিনতে-চিনতে আপনার চেনার বস্তাটি ভর্তি হয়ে গেছে, হরিপদ কাপালীকে চেনার ফুরসৎ কই! ইনি কৃষক, ইনি চাষি, আপনার ভাষায়─ চাষা; এবং, ইনিই বাংলাদেশ। হ্যাঁ, এঁরাই আমার মাতৃভূমি, বাংলার ধানক্ষেত।
২০১৭ সালের ৬ জুলাই, সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে, নিজ ভাঙাচোরা কুটিরটির ভিতরেই, এই জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন, দরিদ্র এই মানুষটি, আমরা কখনোই যাঁকে ‘বিজ্ঞানী’ বলিনি, সেই তিনি, চাষী হরিপদ কাপালী। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই স্বীকৃতিহীন কৃষি বিজ্ঞানীকে।