:: ফিচার ডেস্ক ::
এক সাহেবের জীবনী হাতে এসেছিলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন মুচি বা চর্মকার। তাঁর জীবনীটি পড়ে এমনই মুগ্ধ হয়ে যান বিভূতিভূষণ যে তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়েন। পুরো জীবনীটি বিভূতিভূষণ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।শুধু তাই নয়, তাঁর মনে হয়েছিল এ জীবনী পড়া উচিত চাকরি প্রত্যাশী প্রত্যেকটি তরুণ তরুণীর। তিনি ছুটলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল খ্যাত আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছে। সে জীবনী পড়ে আচার্য্যও মুগ্ধ ! তিনি বিভূতিভূষণের বইটির ফরওয়ার্ডও লিখে দিলেন। দুঃখের বিষয়, বইটি ছাপা হলেও জনপ্রিয় হয়নি। চর্মকারের জীবনী আবার কে পড়ে!
টমাস বাটা ছেলেটির জন্ম চেকোস্লোভাকিয়াতে, মাত্র ১০ বছর বয়সে সে মাতৃহারা।তার বাপ-ঠাকুরদা সবাই ছিলেন দক্ষ চর্মকার।৬ বছর বয়স থেকে বাবার কাছে চামড়ার কাজ শিখতে শুরু করেন। ১২ বছর বয়সেই টমাস জুতো তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে, কিন্তু এই ছেলেটির চোখে তখন অন্য স্বপ্ন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ছেলেটি তার দাদা আন্তোনিন ও দিদি অ্যানাকে বুঝিয়ে বলেন যে একটা ছোট্ট দোকান থেকে আর ক’টা জুতো বিক্রি হবে, তার চেয়ে চল আমরা তিন ভাইবোন মিলে একটা জুতোর কোম্পানি বানাই তাতে জুতো বিক্রি হবে অনেক বেশি আর সে কোম্পানিতে কর্মসংস্থানও হবে কিছু মানুষের। কুড়িয়ে বাড়িয়ে মাত্র ৩২০ ডলার জোগাড় করতে পেরেছিলেন তিন ভাইবোন আর তাই দিয়েই ১৮৯৪তে তাঁরা বানিয়ে ফেললেন একটি জুতোর কোম্পানি।
মাত্র ১০ জন কর্মীকে নিয়ে শুরু হওয়া সে কোম্পানিটি কিন্তু একবছরেই দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। জুতো তৈরির চামড়া কেনার টাকাও ছিল না। অন্য কেউ হলে ব্যবসার সেখানেই ইতি টানতেন, কিন্তু তিনি সেখান থেকেই শুরু করলেন। বললেন চামড়া নেই তো কী হয়েছে, ক্যানভাস কাপড় দিয়ে বানাবো জুতো। বানাতে খরচ বেশি নয়, তাই দামেও হবে সস্তা। নতুনভাবে হলো “জুতা আবিষ্কার” ! তৈরি হলো পৃথিবীর প্রথম ক্যানভাসের জুতো (যেটিকে আমরা বলি কেডস) আর সেই জুতো বাজারে পড়া মাত্র সুপারহিট ! একবছরের মধ্যে দেনা শোধ করে ঘুরে দাঁড়ালো টমাস সাহেবের কোম্পানি!
টমাস সাহেব বুঝেছিলেন প্রোডাকশন বাড়াতে হলে আমেরিকার আবিষ্কার অ্যাসেম্বলি লাইন বস্তুটি আয়ত্ত করতেই হবে। চলে গেলেন আমেরিকা। হাতে কলমে শিক্ষার অন্ধভক্ত ছিলেন তিনি! একবার তাকে একটি স্কুলে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়েছিল। ক্লাসে গিয়ে দেখেন বাচ্চারা মিশ্রণের অনুপাত নিয়ে জটিল অঙ্ক করছে ব্ল্যাকবোর্ডে। তিনি বললেন “ফেলে দাও এসব অঙ্ক, চলো কেক বানাই ! মিশ্রণ আর অনুপাত শেখার ওর থেকে ভালো অঙ্ক নেই !” সেই ক্লাসে সত্যি সত্যিই তিনি কেক বানিয়েছিলেন! এই প্রাক্টিকালিটি থেকেই চেকোশ্লোভাকিয়ায় রাস্তাগুলোকেও রিডিজাইন করে দিয়েছিলেন উনি। এই ব্যাপারে তাঁর উক্তিটিকে সুন্দর অনুবাদ করেছিলেন বিভূতিভূষণ- “পথের দৈর্ঘ্য কম হলে, জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়ে”!
এই বাস্তবতা দিয়েই জটিল সমস্যার সহজ সমাধান করেছেন টমাস সাহেব। একবার দেখা গেলো কারখানা থেকে শোরুমে নিয়ে যাওয়ার পথে চুরি যাচ্ছে জুতোর বাক্স ! সবাই টমাস সাহেবকে বুদ্ধি দিলো সিকিউরিটি গার্ড ভাড়া করার। তিনি বললেন “প্রথমে বাঁ পায়ের সব জুতোগুলো পাঠিয়ে দাও, তার দু’দিন পর ডান পায়ের” ! জুতো চুরি রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেলো ! ওনার জুতোর দামও তাই উনি অদ্ভুতভাবে ৯ সংখ্যাটা দিয়ে শেষ করতেন, কেননা উনি বুঝেছিলেন ১০০র জায়গায় ৯৯ লিখলে ক্রেতারা বলবেন “একশো টাকারও কমে পেলাম।” সেই ট্র্যাডিশন কিন্তু আজও চলেছে !
আমেরিকা থেকে ফিরে অ্যাসেম্বলি লাইনের সাহায্যে টমাস সাহেব তার প্রোডাকশন বাড়িয়ে ফেললেন প্রায় ১০ গুন, কোম্পানির তখন রমরমা ব্যবসা। এর মধ্যে মারা গেলেন তাঁর দাদা আন্তোনিন, দিদি অ্যানা বিয়ে করে ব্যবসা ছেড়ে চলে গেলেন। কোম্পানির হাল ধরলেন টমাস। তিনি বুঝেছিলেন ব্যবসা আসলে টীমওয়ার্ক, তাই তাঁর কর্মচারীদের তিনি মুনাফার ভাগ দিতে লাগলেন। কিন্তু শর্ত হলো ব্যবসায় মন্দা এলে তাঁরা সে ক্ষতির ভাগও নেবেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারি জুতো তৈরির বিরাট কন্ট্রাক্ট পেলেন টমাস সাহেব, তাঁর ব্যবসা তখন সাফল্যের শিখরে!
১৯৩২ সালে সুইজারল্যান্ডে কোম্পানির একটি শাখা উদ্বোধন করতে গিয়ে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান টমাস বাটা। আর কী আশ্চর্য, ৭২টা দেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর তৈরি জুতোর কোম্পানির এই মুহূর্তে হেডকোয়ার্টার ওই সুইজারল্যান্ডেই!
টমাস সাহেবের বানানো জুতো আমরা সবাই পরেছি। এই টমাস সাহেবই হলেন বাটা শ্যু কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা টমাস বাটা।