:: তানজিনা আফরিন টুম্পা ::
চৌধুরী ভবন আজ নতুন সাজে সেজেছে।পুরা বাড়ি আজ বিয়ের সাজে সাজানো হচ্ছে। চারিদিকে একটা খুশির আমেজ।আর হবে না কেনো,কারন এই বাড়ির একমাত্র মেয়ের দুইদিন পরেই বিয়ে।সেইজন্য এত্ত আয়োজন আর সবার এত্ত ব্যস্ততা।বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ির কোনায় কোনায় আজ পরিষ্কার করা হচ্ছে আর সাজাতে ব্যস্ত ওয়েডিং প্লানারের টিম।চৌধুরী সাহেব ধীরে ধীরে মেয়ের রুমের দিকে যাচ্ছেন।মেয়েটা দুইদিন পরে চলে যাবে,ভাবতেই চোখের কোনে জল চলে আসছে।দরজায় নক করে রুমে প্রবেশ করতেই মেয়ের হাসিমাখা মুখ দেখে উনার মনটা জুড়িয়ে গেলো।
চৌধুরী সাহেব:কিরে মা।কি করছিস?
অরুনিমা:এইতো বাবা,তেমন কিছু না।জামা বাছাই করছি,আজকে কোনটা পরব।
চৌধুরী সাহেব: ভালো,ঠিকমত বাছাই কর।আমি চাই আমার মেয়েকে যেন আজকে পরীর মত লাগে।
অরুনিমা :তোমার মেয়েতো বাবা এমনিতেই পরী।বলেই হেসে উঠল অরুনিমা আর সাথে তাল মেলালেন চৌধুরী সাহেব।পাশ ফিরে তাকাতেই মেয়ের পাশে নিউ সার্ভেন্টকে দেখতে পেলো চৌধুরী সাহেব।
চৌধুরী সাহেব:ঠিক আছে মা,তুই তোর কাজ কর,আমিও আমার কাজ করি।সবাই চলে আসছে,তাই আর দেরি করা ঠিক হবে না।
অরুনিমা:ওকে বাবা,লাভ ইউ।
চৌধুরী সাহেব:লাভ ইউ টু মা।তুই না থাকলে এই বাসাটা একদম ফাঁকা হয়ে যাবে।বলেই উনার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।
অরুনিমা :বাবা প্লিজ,এইভাবে বলো না।আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি?আমি তোমার মেয়ে ছিলাম,আছি আর থাকব আর এই বাসায় আসব।বলেই ফিক করে হেসে উঠল।
অরুন নিজের ঘরে চলে গেলো আর অরুনিমা নিজের ঘর থেকে বের হতেই রাহেলা বেগমের কথার ফুলঝুরি শুরু হলো। অরুনিমা কিছু না বলে কাজে মন দিলো আর হাসতে লাগলো। মনে মনে ভাবছে,সবার জীবন এক রকম হয় না,সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না। তাতে কি, নিজের মত করে পূরন না হওয়া সেই স্বপ্ন জেগে জেগে বা ঘুমিয়ে দেখেই ক্ষনিকের সেই আনন্দ নিয়েই বেচেঁ থাকার লড়াই চালিয়ে যাই আর দেখে যেতে থাকি আমার নিজের হাতে বোনা ছেঁড়া কাথার স্বপ্ন।
চৌধুরী সাহেব আর কিছু না বলে চলে গেলেন।যাবার আগে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। বাবা-মেয়ের আবেগঘন সময়ের সাক্ষী নিউ সার্ভেন্ট চুপচাপ সব দেখতে থাকল।কিছুক্ষণ পরে অরুনিমা একেকটা জামা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজেকে দেখতে লাগলো আর পছন্দ না হলে সেটা সার্ভেন্টকে দিচ্ছে ঠিক করে রাখার জন্য।
অরুনিমা নিজেকে আয়নায় দেখছে আর ভাবছে,আই নো আমি যেটাই পরি না কেনো আমাকে ভালো লাগবে বাট আমাকে বেস্ট লাগতে হবে।আফটারঅল আমার বিয়ে বলে কথা।বলেই মুচকি হাসি দিলো।সবাই তো চায় নিজের বিয়েতে যেন সবার থেকে নিজেকে আলাদা লাগে।সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে অরুনিমা পার্লারে যাওয়ার জন্য রেডি হলো।
সন্ধায় সব আত্বীয়-স্বজন আসতে লাগলো।আজকে মেহেদী প্রোগ্রাম।অরুনিমা নিজে আজকে অনেক খুশী।পার্লার থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলো।
অরুনিমা মোবাইলে সেল্ফি তুলতে তুলতে নিজেকে দেখে নিচ্ছে সব ঠিক আছে কিনা।আজকে একদম পারফেক্ট লাগা চাই।শুধু আজকে না,হলুদ আর বিয়েতেও।মেহেদী অনুষ্ঠানের সব আয়োজন শেষ।অরুনিমা স্টেজে বসে আছে।ফটোগ্রাফারা সব ছবি তুলতে ব্যস্ত।একটু পর আদনান আসবে।আদনান হোসেন,অরুনিমার হবু বর।পেশায় বিজনেসম্যান।বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি টাকা-পয়সার অভাব নেই।দুই পরিবারের সবাই খুশী এই বিয়েতে।দুইজনকে মানিয়েছে ভালো। সব কিছু পারফেক্ট। অরুনিমার কাজিনরা সব চলে এসেছে।সবাই পিক তুলতে ব্যস্ত, কেউ অরুনিমার সাথে তুলছে,কেউ আবার একা।অরুনিমার একমাত্র ভাই আজ অনেক ব্যস্ত কিন্তু বোনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসিটা দিতে ভূলে নাই।ভাইটা অরুনিমার ছোট হলেও অনেক আদরের আর অনেক ক্লোজ।চারিদিকে সবাই হাসি-খুশী।অন্য রকম এক উৎসবমুখোর পরিবেশ।আদনান তার পরিবারের সবার সাথে চলে আসল।সবাই ওদেরকে সাদরে বরন করে নিল আর আদনানকে অরুনিমার পাশে স্টেজে বসিয়ে দিল।ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরার ঝলকানিতে একের পর এক ছবি উঠছে।বর-কনে একেক পোজ দিয়ে ছবি তুলছে,মেহেদী দেয়া হচ্ছে অরুনিমার হাতে।চারিদিকে আনন্দের বন্যা।অরুনিমা আর আদনান একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি বিনিময় করল।মেহেদীর অনুষ্ঠান শেষে একে একে হলুদের অনুষ্ঠানের সব আয়োজন শেষ হয়ে গেলে চলে আসল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।যে সময়ের অপেক্ষায় অরুনিমা আর আদনান করছে।আজ ওদের বিয়ে।পার্লারের আয়নায় নিজেকে দেখে নিচ্ছে অরুনিমা।আজকে যেন সবার থেকে আলাদা লাগে,যেন সবাই ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সেইজন্য কোন ত্রুটি যেন না থাকে সেই ডিরেকশন দিয়ে দিচ্ছে মেকাপ আর্টিস্টকে।স্টেজে বসে অরুনিমা আদনানের আসার অপেক্ষায় আছে।হঠাৎ করেই চারিদিকে হইচই পরে গেলো বর এসেছে,বর এসেছে।অরুনিমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল।সকল জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আদনানকে নিয়ে অরুনিমার ভাই আর কাজিনরা আসল আর অরুনিমার পাশে স্টেজে বসিয়ে দিয়ে গেলো।দুজন দুজনকে এক পলক দেখে লাজুক হাসির বিনিময়ে সামনে তাকাতেই সবাইকে দেখতে পেলো আর সেইসাথে চলছে ক্যামেরার ফ্লাশের ঝলকানি।একটু পর সকল মুরুব্বীদের সাথে ছোটরাও আসল কাজী সাহেবকে নিয়ে বিয়ে পড়ানোর জন্য।বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে সবাই মালা-বদলের জন্য বলল।অরুনিমা হাসি মুখে আদনানের দিকে তাকালে দেখতে পেলো আদনান নিজেও হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।দুজন দুজনকে মালা পড়ানোর জন্য প্রস্তুত।অরুনিমা নিজের হাতের মালা আদনানকে পড়াতে নিলে হঠাৎ করেই কেমন শোরগোল শুনতে পাচ্ছে।অনেক বেশি চিৎকার, চেঁচামিচি হচ্ছে।
অরুনিমা শুনতে পাচ্ছে-
–ওই কন্ডাকটর,এত বেশি ভাড়া রাখসোস কেন?
–ঠিকি ভাড়া রাখছি,এইখান থেইক্কা ভাড়া এটাই,নাইলে নাইম্মা যান।
–ওই,বেশি কথা বাড়াইস না,মাইর চিনস?
–ওই কন্ডাকটর,আমার বাকি টাকা ফেরত দে।
–আরেহহ আস্তে ব্রেক দেন ড্রাইভার সাহেব।
বাস অনেক জোরে ব্রেক করল আর সেইসাথে ঝাক্কি খেয়ে অরুনিমার চোখ খুলে গেলো।নিজেকে বাসের সিটে আবিষ্কার করল।সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো বাসের মধ্য ছোট-খাটো জটলার মত।কন্ডাকটরের সাথে বাসের যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলছে।বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে।তাই আর বাসে বসে দেরি না করে বাস থেকে নেমে হেটেঁ যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করল।বাসায় পৌছাতেই দরজা খুলে দিলো অরুনিমার মা।
–কিরে নবাবজাদি, আসার সময় হইসে তোর?বলি কোথায় গেসিলি?
–মা,আগেই বলেছিলাম তোমাকে।স্টুডেন্টের বোনের বিয়ে,বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম,কনের ফুটফরমায়েশ কাজে হেল্প করার জন্য।
–এহহ,বলি ওইখানে যে গেলি,টাকা পাইসোস??
–হুম,টাকা দিয়েছে।
–কই দেহি,কত্ত দিসে?চকচক করে উঠল রাহেলা বেগমের চোখ।
–ব্যাগ থেকে বের করে দিচ্ছি।আগে একটু ফ্রেস হয়ে নেই।
–ইশশ,নবাবের বেটি,আইসে উনি ফ্রেস হবে।এইসব রং-তামাশা যে আর কত দেখতে হইব।বলেই মুখ ঝামটা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।অরুনিমা মায়ের গমন পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।রাহেলা বেগম ওর সৎ মা।ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় মা মারা যাওয়ার পর বাবা বিয়ে করে এই নতুন মাকে নিয়ে এসেছিল।অরুনিমা ভেবেছিল নতুন মা ভালো হবে কিন্তু কয়েকদিন পরেই সে তার আসল চেহারা দেখাতে শুরু করল।এরপর থেকেই অরুনিমার জীবনযুদ্ধ শুরু। নিজের ঘরের দিকে যেতেই বাবার সাথে দেখা।হুইল চেয়ারে বসে থেকেই উনার বাজখাঁই চিৎকার শুরু হলো ওকে দেখে।
–অই,তোর মা টাকা চেয়েছে দিলি না কেনো?
–বাবা,আমি বলেছি দিবো।মাত্রই তো আসলাম।
–মুখে মুখে তর্ক করস তুই আমাদের সাথে।বেশি বেড়ে গেছোস তুই।
আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বাবার হাতে দিয়ে দিলাম।ওমনি রাহেলা বেগম এসে ছোঁ মেরে বাবার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে গুনতে লাগল।বাবার মুখটা পাংশু বরন ধারন করলেও হাসি মুখে রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।টাকা গুনায় ব্যস্ত সে অন্যদিকে খেয়াল নেই।অরুনিমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু সেটা দেখার কারো সময় নেই।নিজের রুমে এসে খাটে বসতেই অরুন এসে হাজির।অরুন,অরুনিমার একমাত্র ছোট ভাই আর এই বাড়ির একমাত্র মানুষ যে ওকে আপন ভাবে।
–বুবু,তুই আবার কান্না করতাসোস?
–নারে,কান্না করি না,মাঝে মাঝে চোখ থেকে এমনি কিছু নোনাজল পড়ে।
–পড়তে দিবি না এই নোনাজল।আমি আছি না।একদিন আমি তোর সব কষ্ট দূর করে দিবো।ভাইয়ের কথা শুনে অরুনিমার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
–আমি জানি,সেই দিনের অপেক্ষায় তো আছি রে ভাই।
–বিয়ে বাড়িতে অনেক মজা করলি না?
–হুম,সারাক্ষণ কনের সাথে ছিলাম।সব টুকটাক কাজে হেল্প করেছি।সবাইকে দেখেছি আর তোকে মিস করেছি।
–আর তোর স্বপ্ন দেখোস নাই?
–ওইটা তো অবশ্যই দেখেছি।বলেই হেসে উঠল অরুনিমা।
–কি কি দেখলি আজকে?
–কনের জায়গায় নিজের বিয়ে দেখেছি,বাবার আদর নিয়েছি,ভাইয়ের ভালোবাসা নিয়েছি,সুন্দর বর আর সংসার পেয়েছি,নিজেকে অপরুপ সাজে সাজিয়েছি।কথাগুলো বলেই মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল অরুনিমা।
–তুই এত্ত কাঁদিস কেন?তুই তো তাও নিজের মত করে স্বপ্ন দেখে আনন্দ পাস,আমি তো তাও দেখতে পারি না।দেখার যে সেই চোখ নেই আমার।ভাইকে জড়িয়ে ধরল অরুনিমা।
–তোর চোখ ভালো হয়ে যাবে।আমি টাকা জমিয়ে তোর চোখের চিকিৎসা করাবো।
–আর কত করবি তুই বুবু?নিজের পড়াশোনার খরচ নিজে চালাস,টিউশনি করস,ঘরের কাজ করস,বেশি টাকা পাওয়ার আশায় মানুষের বাড়িতে গিয়ে আলগা কাজ করস।
–তো কি হয়েছে?আমার ভাইয়ের জন্য সব করি।আর কারো জন্য না।দুই ভাই-বোন নিজেদেরকে সান্তনা দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল।একে অপরের চোখের পানি মুছে দিলো।
–বুবু,তুই নিজের মত করে এইসব স্বপ্ন দেখে কি পাস?
–জীবনে যা পাই নাই,পাবো না তাই দেখে ক্ষনিকের আনন্দ পাই।
–এতে কি লাভ আছে বলতো আমায়?
–বোকা ছেলে,কোন লাভ-ক্ষতি নেই।এই যে বাবা আমায় ভালোবাসে না কিন্তু আমার স্বপ্নে বাবার কাছ থেকে ভালোবাসা নেই,নিজেকে সুন্দর বানাই,আরো কত কি।
–আর মা??তোর স্বপ্নে মা কেনো থাকে না?
–আমার মা আমাকে একা রেখে চলে গেছে তাই থাকে না।আর নতুন মাকে স্বপ্নে দেখতেও ভয় হয়।তাই থাকে না।
–একদিন দেখবি তোর সব স্বপ্ন পুরন হবে।
–আমার স্বপ্ন পূরন হোক আর নাই হোক।আমার এই ছেঁড়া কাথার স্বপ্ন আমি নিজে দেখে যে সাময়িক আনন্দ পাই সেটাই অনেক।আর কিছু লাগবে না।ওইদিকে রাহেলা বেগমের চিৎকার শুরু হয়ে গেছে।
–বলি নবাবের বেটি,কাজ কাম কি কিছু করা লাগবো না।তিনদিন পরে বাসায় আইসা রঙ তামাশা শুরু করছে।
–ভাই,তুই তোর ঘরে যা।আমি যাই মাকে কাজে সাহায্য করি।
অরুন নিজের ঘরে চলে গেলো আর অরুনিমা নিজের ঘর থেকে বের হতেই রাহেলা বেগমের কথার ফুলঝুরি শুরু হলো। অরুনিমা কিছু না বলে কাজে মন দিলো আর হাসতে লাগলো। মনে মনে ভাবছে,সবার জীবন এক রকম হয় না,সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না। তাতে কি, নিজের মত করে পূরন না হওয়া সেই স্বপ্ন জেগে জেগে বা ঘুমিয়ে দেখেই ক্ষনিকের সেই আনন্দ নিয়েই বেচেঁ থাকার লড়াই চালিয়ে যাই আর দেখে যেতে থাকি আমার নিজের হাতে বোনা ছেঁড়া কাথার স্বপ্ন।