:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
নানা অনিয়ম ও বেনামে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত এস আলম গ্রুপের সহযোগী ইসলামী ব্যাংকের পাঁচ ডিএমডিসহ আট শীর্ষ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এর মধ্যে একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) ও পাঁচজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)। বাকি দুজন ব্যাংকের দুটি বিভাগের প্রধান।
বরখাস্তরা হলেন- অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক জে কিউ এম হাবীবুল্লাহ (এএমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. আকিজ উদ্দিন, মোহাম্মদ সাব্বির, মিফতাহ উদ্দিন, মো. রেজাউল করিম ও ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া প্রধান অর্থপাচার প্রতিরোধ কর্মকর্তা তাহের আহমেদ চৌধুরী ও আইবিটিআরএ প্রিন্সিপাল মো. নজরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের সবাই এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। এর মধ্যে সাইফুল আলমের একান্ত সচিব আকিজ উদ্দিন ও ইসলামী ব্যাংকের ঋণের দায়িত্বে থাকা মিফতাহ উদ্দিনও রয়েছেন। তাঁরা দুজনই ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন। এই দুই কমকর্তা ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ও মানবসম্পদ বিষয়গুলো দেখভাল করতেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটিতে যেতে পারছেন না এস আলমপন্থি কর্মকর্তারা। তবে রোববার (১৮ আগস্ট) ও সোমবার (১৯ আগস্ট) অফিসে যান ব্যাংকটির এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা। এরপরই তাদের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপকে বিপুল ঋণ দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
সরকার পতনের পর থেকে ব্যাংকটিকে ‘এস আলম ও পটিয়া মুক্ত’ করার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি ঋণ বিতরণে অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের বিচার দাবি করছেন। এ ছাড়া গত ৭ বছরে সাইফুল আলমের নিজের এলাকা চট্টগ্রামের পটিয়ার প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ব্যাংকটির এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংককে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ হিসেবে এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নেয় আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে গ্রুপটি। এই টাকা বের করতে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। ঋণের যে তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, ব্যাংক থেকে পাচার করা অর্থের প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে বেশি বলেই মনে করেন কর্মকর্তারা।
ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ও কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ব্যাংকের তহবিল লুটপাটের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। বাস্তব অবস্থা এর চেয়েও ভয়াবহ। দীর্ঘদিন এই লুটপাটের ধারা অব্যাহত থাকার কারণে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং ব্যাংকটির প্রতি গণমানুষের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পুনর্গঠনের দাবি করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি এস আলম গ্রুপের সহযোগী সব কর্মকর্তার বরখাস্ত করার দাবি জানান ব্যাংকটির সাধারণ কর্মীরা। এ বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে চিঠি দিয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের কর্মীরা।
সর্বস্তরের কর্মীদের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের এসইভিপি এএসএম রেজাউল করিম সই করা চিঠিতে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার, ব্যাংকের সব স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা, তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় চালু করার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন ৪৭ ধারা অনুযায়ী ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত, ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গ অথবা প্রয়োজনে প্রাক্তন পরিচালকদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে বোর্ড পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আপনার আশু পদক্ষেপ কামনা করছি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৬ আগস্ট এস আলমের নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বের করে দেন বিক্ষুব্ধ ব্যাংকাররা। এরপর গত ৭ এবং ৮ আগস্ট ব্যাংকারদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের পর পদায়ন পাওয়া এক্সিকিউটিভসহ (নির্বাহী কর্মকর্তারা) যারা অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ বাতিলের দাবি করেন। এমন অবস্থায় গত বুধবার এস আলমের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে এলে তাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
কর্মকর্তারা ইসলামী ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে লুটেরাদের বের করে দেওয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা, অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাউসার আলী, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিনসহ এ সালামের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের ব্যাংক থেকে বহিষ্কারের দাবি করেছিলেন ব্যাংকের কর্মীরা।
এস আলমের ৬ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বন্ধ
বেনামে ঋণ ও অর্থপাচার ঠেকাতে প্রভাবশালী এস আলম গ্রুপের ছয় ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
সোমবার (১৯ আগস্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আজ থেকে অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য এ ছয়টি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও এলসি খোলা বন্ধ থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব ব্যাংক নতুন করে ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। আগের ঋণ নবায়নও করতে পারবে না। তবে কৃষি, চলতি মূলধন, এসএমই, আমানতের বিপরীতে ঋণ ও প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত দিতে পারবে। পাঁচ কোটি টাকার বেশি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে টানা প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন দুঃশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটে। সরকারের পতনের পর এস আলম গ্রুপ ব্যাংক থেকে অর্থ সরাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় বেনামি ঋণের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপের দখলে থাকা বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক থেকে কাগজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একইদিনে ৮৮৯ কোটি টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যাংকের কর্মকর্তারা তা জানতে পেরে এসব লেনদেন আটকে দেন। অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল গোল্ডেন স্টার ও টপ টেন ট্রেডিং হাউজ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান।