:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
সারাদেশে এখন পর্যন্ত বন্যায় মারা গেছেন ১৫ জন। দেশের ১১ জেলার ৭৭ উপজেলা বন্যাকবলিত। এসব এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ। আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯টি।
শুক্রবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ বন্যাকবলিত হয়েছে।
কামরুল হাসান বলেন, ‘বন্যায় মারা গেছেন ১৫ জনের মধ্যে পুরুষ ১৩ জন, নারী ২ জন। মারা যাওয়ার মধ্যে কুমিল্লায় ৪, ফেনীতে ১, চট্টগ্রামে ৪, নোয়াখালীতে ১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ এবং কক্সবাজারে ৩ জন রয়েছেন।
তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে, পানিবন্দি/ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৩,১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ১ লাখ ১৫ হাজার ৩০ জন লোক এবং ১৮ হাজার ৯৬টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৩৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
বন্যা আক্রান্ত জেলাসমূহের জেলা প্রশাসককে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে এক সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দেশের বন্যাকবলিত ১৩ জেলার প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ। অনেক তথ্য টেলিযোগাযোগ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় জানা যাচ্ছে না। তবে বন্যায় দুজন মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
আট জেলায় গত বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। আরও পাঁচ জেলাসহ মোট ১৩ জেলা গতকাল বৃহস্পতিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এবং সচিব বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বন্যা উপদ্রুত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। উপদেষ্টা এখনও উপদ্রুত এলাকায় অবস্থান করছেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বর্তমানে উপদ্রুত এলাকায় অবস্থান করছেন।
বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনা মোতায়েন সর্ম্পকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের মিরসরাই, কুমিল্লার বুড়িচং, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় বন্যার্তদের উদ্ধার কার্যক্রমে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশন, ২৪ পদাতিক ডিভিশন এবং ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের সেনাসদস্যরা পানিবন্দী মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সহায়তা করছেন। এ ছাড়া ফেনী, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে সেনাবাহিনীর পাঁচটি চিকিৎসা দল সহায়তার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার বন্যাদুর্গত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। পাশাপাশি বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ ও খাদ্য বিতরণ করছে।
বৃহস্পতিবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মোবাইল টাওয়ার অচল বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় মোবাইল ফোনের ২১ দশমিক ৬ শতাংশ টাওয়ার অচল হয়ে গেছে। ফেনী ও খাগড়াছড়ি জেলার প্রায় অর্ধেক মোবাইল টাওয়ার কাজ করছে না। এসব এলাকায় নেটওয়ার্কব্যবস্থা সচল রাখতে ভি–স্যাট পাঠানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত বন্যাপ্লাবিত জেলাগুলোয় মোট ৬ হাজার ৯৮৬টি টাওয়ারের মধ্যে ৫ হাজার ৪৭৬টি সচল আছে। টাওয়ার অচল হয়েছে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনীতে, এই জেলার টাওয়ারের ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ অচল হয়ে গেছে। আর খাগড়াছড়ির ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ টাওয়ার এখন অচল আছে। এসব টাওয়ার সচল করতে কাজ করা হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুরে ২০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন
লক্ষ্মীপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। আজ শুক্রবার জেলার ৫টি উপজেলায় বন্যার পানির উচ্চতা গতকালের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। অনেক স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটি হেলে পড়ায় ও তারে গাছ উপড়ে পড়ার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় প্রায় ২০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছেন। শুক্রবার দুপুরে পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রথম আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে জেলার মেঘনা নদীসহ খাল-বিলের পানি বেড়ে গেছে। এতে জেলা সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়ন এখন পানিতে ডুবে আছে। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু পানি আর পানি। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ পানিতে ডুবে আছে। এ কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন লাখো মানুষ।
লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের তথ্যমতে, লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৫ লাখ ৩৭ হাজার গ্রাহক আছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে তিন দিন ধরে তাঁদের বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। জেলায় ১৩টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আছে। উপকেন্দ্রগুলো ছুঁই ছুঁই করছে পানি। পানি বেড়ে ভেতরে ঢুকলে জেলায় পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে। জেলার পাঁচটি উপজেলায় অনেক বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়েছে। অনেক স্থানে গাছ উপড়ে পড়ে তার ছিঁড়ে গেছে। এতে তারগুলো পানিতে ডুবে গেছে।
পেকুয়ায় ৩৫ গ্রাম প্লাবিত
কক্সবাজারের পেকুয়ায় ভারি বর্ষণে ও উজানের ঢলে উপজেলার শিলখালী ও টইটং ইউনিয়নের অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়ছে এসব ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। পানির তোড়ে ভেঙে অন্তত ১১টি গ্রামীণ সড়ক।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়া সড়কের অন্তত ১০টি স্থানে ভেঙে গেছে। জারুলবনিয়া স্টেশন এলাকায় পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ৩০ ফুট সড়ক ভেঙে মানুষের বসতঘরে পানি ঢুকেছে। ধসে পড়েছে মাটির দেয়ালের অন্তত ১২টি বসতঘর।
এদিকে শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়া, সেগুনবাগিচা, টুইন্যামোড়া, ভেটভেটি পাড়া, মাঝেরঘোনা, চেপ্টামোড়া, হেদায়াতাবাদ, মাতবরপাড়া, কাছারীমোড়া, টইটং ইউনিয়নের বটতলী ১নং ওয়ার্ডের মালাগাড়া, আলিগ্যাকাটা, কোনা পাড়া, বকসো মুরা, ওয়াছ খাতু পাড়া, নতুন পাড়া, হাবিব পাড়া, রিজাভ পাড়া, ২নং ওয়ার্ডের পন্ডিত পাড়া, শের আলি মাস্টার পাড়া, হাজির পাড়া, মিত্যান্ত ঘোনা, ৩ নং ওয়ার্ডের বাজার পাড়া, ৫ নং ওয়ার্ডের বড়পাড়া, পুরাদিয়া, বাজার পাড়া, ৭ নং ওয়ার্ডের হাজিবাড়ি, মাঝর পাড়া, ৮ নং ওয়ার্ডের হিরাবুনিয়া পাড়াসহ প্রায় ২২টি গ্রামের অন্তত দুই শতাদিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে।
চলাচলের রাস্তার এ পাশ থেকে অপর পাশে স্রোতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। মানুষের ধান, মাছ, সবজি ক্ষেতসহ ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এ ছাড়াও টইটং উচ্চ বিদ্যালয়, টইটং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টইটং ইক্বরা স্কুল, টইটং আলহেরা মডেল একাডেমি, হাজিবাজার আহালিয়া ইলামিয়া বালিকা মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্লাবিত হওয়ায় ব্যাহত হয় শিক্ষা কার্যক্রম।
টইটং হাজির বাজার হতে রমিজপাড়া সংযোগ সড়কের মাঝের পাড়া এলাকার ৬০ ফুট রাস্তা ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। শীলখালী জারুলবুনিয়া সড়কের মাঝ অংশ বিলীন হয়ে গেছে। ফলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসব এলাকার মানুষ এখন গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে।
শিলখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আহমদ শফি বলেন, পাহাড়ি ছড়া ছোট হয়ে যাওয়ায় ও ছড়া দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করায় ঢলের পানি উপচে এবং ভেঙে মানুষের বসতঘর প্লাবিত হচ্ছে। বৃষ্টি না কমলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
শিলখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, অতি বৃষ্টির ফলে শিলখালীর জারুলবনিয়া সড়কের ১০টি স্থানে ভেঙে গেছে। অন্তত ১২টি বসতঘর ধসে পড়েছে।
এদিকে ইউপির সদস্য আবদুল জলিল বলেন, কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণে টইটংয়ে ডুবে গেছে অন্তত ২২টি গ্রাম। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ধানের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত। বেশিরভাগ বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। চরম বেকায়দায় ও দুর্ভোগে দিন পার করছে এখানকার মানুষ।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) পেয়ারু বেগম বলেন, ভারি বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে পেকুয়ার বেশ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ও মাছ, ধানের চারা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে।
বিপৎসীমার ওপরে দক্ষিণাঞ্চলের ৯ নদীর পানি
দক্ষিণাঞ্চলের ৯ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার রিপোর্ট অনুযায়ী দক্ষিণাঞ্চলের ৯ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ঝালকাঠির বিষখালী নদী বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বরগুনার বেতাগী উপজেলা পয়েন্টে বিষখালীর পানি ১৪ সেন্টিমিটার, ভোলার দৌলতখান উপজেলার সুরমা-মেঘনায় ৭১ সেন্টিমিটার, তজুমদ্দিন উপজেলার সুরমা-মেঘনায় ৮৭ সেন্টিমিটার, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে পায়রা নদীর পানি ৩ সেন্টিমিটার, বরগুনা সদর উপজেলার বিষখালী নদী ১১ সেন্টিমিটার, পাথরঘাটা উপজেলায় ১০ সেন্টিমিটার, উমেদপুর পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার ও পিরোজপুর জেলার বলেশ্বর নদীর পানি বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বৈরী আবহাওয়া ও ভারত থেকে আসা ঢলে ৯ নদীর পানি বেড়েছে।
ফেনীর ৬ উপজেলার লাখো মানুষ এখনো পানিবন্দী
ফেনী জেলার ছয় উপজেলা এখনো প্লাবিত। পানি সরে যায়নি। পানিবন্দী হয়ে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
ছাগলনাইয়া উপজেলার ১০ নম্বর ঘোপাল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিজকুঞ্জরা গ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বন্যার পানিতে চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী একটি বাস আটকা পড়েছে। বাসটিতে ৫০ জনের মতো যাত্রী আছেন। গত বুধবার বাসটি চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে এসেছিল।
উজানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল ও গত কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টিতে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম—এ তিন উপজেলা পুরোটাই বন্যাকবলিত। জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার ৮০ শতাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সোনাগাজী উপজেলার সব ইউনিয়নে বন্যার পানি ঢুকেছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দুর্ভোগে আছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন গ্রামে প্রায় এক লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দী অবস্থায় আছেন। বন্যাকবলিত প্রায় সব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। বেশির ভাগ মোবাইল টাওয়ার অকেজো হয়ে পড়ায় যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম: পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েকটি উপজেলার হাজারও মানুষ। লোহাগাড়া উপজেলায় গাছ ভেঙে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া সবজি খেত, মাছের খামার, হাঁস-মুরগির খামারের ক্ষতি হয়েছে। ২২ হাজার টন মাছ ভেসে গেছে বন্যায়। ১২ হাজার হেক্টর ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে এ জেলায়।
জানা গেছে, সাত দিন ধরে চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এতে চট্টগ্রামের হালদা, ফেনী নদী, ফটিকছড়ির ধুরুং ও সর্তা খালের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া পূর্বাভাস কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইসমাইল ভূঁইয়া বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।’
ফটিকছড়ি উপজেলার ইউএনও মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘১৫টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মানুষের সেবার জন্য ১৮ জন কর্মকর্তা নিয়ে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। জরুবি সেবার জন্য কন্ট্রোল রুম নম্বর চালু করা হয়েছে। সহযোগিতা করে যাচ্ছে সেনাবাহিনীও।’
এদিকে লোহাগাড়া উপজেলায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পদুয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের নয়াপাড়া এলাকায় চলন্ত মাছবোঝাই একটি মিনি ট্রাকের ওপর গাছ পড়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ছয়জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর, মুরাদপুর, বাড়বকুণ্ড, কুমিরা, বাঁশবাড়িয়ার ৩০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
খাগড়াছড়ি: জেলা সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, মহালছড়ি ও রামগড়ের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার নদী-তীরবর্তী কয়েক শ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কয়েক হাজার বাড়িঘর, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। আটকে পড়াদের উদ্ধার অব্যাহত রেখেছেন সেনাবাহিনী ও রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা। খাগড়াছড়ি শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, তারা গত ২২ বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহ বন্যা আর দেখেননি।
জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, জেলায় ৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে।
ফেনী: ফেনী পৌর শহরেও বন্যার পানি উঠেছে। সদর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর আগে ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মুহুরী নদীর পানি বেড়ে সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ও নবাবপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ঢুকতে শুরু করে। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকালে মুহুরী ও ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছিল।
জেলার বন্যায় উপদ্রুত অঞ্চলে দুর্গতদের সহায়তা ও উদ্ধার তৎপরতায় কাজ করছেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা।
রাঙামাটি: রাঙামাটির বাঘাইছড়ির নিচু এলাকার ৩০টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এতে ১২ হাজার ২০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪টিতে আশ্রয় নিয়েছে ৪৮৫ পরিবারের ১ হাজার ৮২০ মানুষ।
বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আতাউর রহমান জানিয়েছেন, ত্রাণ সহায়তার ৩০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা: জেলার তিনটি উপজেলার এক লাখের বেশি মানুষের ঘরবাড়িতে পানি উঠে গেছে। তারা এখন আশ্রয়কেন্দ্র অথবা আত্মীয়ের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক খন্দকার মু মুশফিকুর রহমান জানান, ভারতীয় ঢল ও বৃষ্টি না কমলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। নদীর তীরবর্তী সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য কাজ করা হচ্ছে।
হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জে রেকর্ড বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে খোয়াই নদীর পানি। রেলসেতু ছুঁয়ে যাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে রেল চলাচল বন্ধ করা হয়।
জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫২ মিলিমিটার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ।
জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার অন্তত ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
মৌলভীবাজার: জেলার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী ও কমলগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অসংখ্য বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। এতে পাঁচটি উপজেলার দুই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মনু ও ধলাই নদের অন্তত ১৩টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১ লাখ ২২ হাজার ৬৮৭ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৪ হাজার ৩২৫ জন। খোলা হয়েছে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র। মেডিকেল টিম রয়েছে ২৫টি। একই সঙ্গে বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ২০ লাখ ৫০ হাজার নগদ টাকা এবং ২৮৫ টন চাল জিআর খাত থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার: বন্যার পানিতে দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া এসব এলাকার আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে গেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: আখাউড়া উপজেলার ৩৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ৫৫০টি পরিবার।
জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুরুল আলম জানান, হাওড়া নদী ও জাজীর খালসহ বিভিন্ন স্থানে পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে।
সিলেট: সিলেটে কুশিয়ারা নদীর চার পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাউবোর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, ‘সিলেটের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি ও বন্যা পরিস্থিতি নির্ভর করে ভারতের পাহাড়ি ঢলের ওপর। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তাই আমাদের নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি অব্যাহত থাকে, তাহলে সিলেটে আবার বন্যার শঙ্কা রয়েছে।